‘দীপক স্যারকে চুল ধরে টান দিয়েছি।’ হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে তৃপ্তির সুরে কথাগুলো বললেন, সন্তান তুল্য এক কিশোর ছাত্র। এরা তাঁদের শিক্ষকদের মারছে! প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পদত্যাগে বাধ্য করার সময়, শিক্ষকদের উপর অকথ্য নির্যাতন করতে গিয়ে,এমন নিষ্ঠুর বাক্যবাণে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে! সামাজিক মাধ্যমে এমন দৃশ্যগুলো এখন ভাইরাল। মূল্যবোধের কতটা চরম অবক্ষয় হলে, স্কুল কলেজের ছাত্ররা শিক্ষকদের উপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে?
বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ত্যাগের সরকার। এ সরকার সফল না হলে, শত শত তরুণের আত্মাহুতি বিফলে যাবে। নিষ্পাপ শিশু সন্তানদের বুলেট বিদ্ধ নিথর দেহটির কথা মনে পড়ে, সন্তানহারা মা পাগলের প্রলাপ বকবে। আবু সাঈদ এর অন্তরাত্মা কষ্টে ছটফট করবে। দুর্নীতি, দু:শাসন থেকে মুক্ত হতে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। এ মৃত্যু অর্থহীন হতে পারে না।
সবচেয়ে অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যখন এ ধরনের বীভৎস দৃশ্যগুলো ঘটে যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে এসব বন্ধে প্রত্যাশিত মাত্রায় কঠিন বার্তা দেখা যাচ্ছে না। জাতির বিবেক বলে পরিচিত, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও নীরব। দেশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী মহলের মুখেও কুলুপ! কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে যৌক্তিকতা তুলে ধরারও চেষ্টা করছেন। আমীরে জামায়াত ডাঃ শফিকুর রহমান সহনশীলতার আহ্বান জানালেও, গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় সুফল ভোগী বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির কোন প্রতিক্রিয়া আজও চোখে পড়েনি!!
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার,অতীতের যে কোনো সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে নানা কারণেই ব্যতিক্রম। এ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ একজন উচ্চমার্গীয় মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষক। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সর্বমহলে পরিচিত গুণী অধ্যাপক ও সচেতন ছাত্র মহলে একজন আদর্শ শিক্ষক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অত্যন্ত ক্ষমতাবানদের একজন। সর্বোপরি নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস জাতির আদর্শ, আশা-আকাঙ্ক্ষার বাতিঘর, ব্যক্তিগত জীবনে তিনিও একজন শিক্ষক, বহু গুণী মানুষের আদর্শ জন্মদাতা পিতৃতুল্য অভিভাবক।
এতোসব গুণী শিক্ষাগুরুর চোখের সামনে শিক্ষালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শুধু অস্বাভাবিক নয়, বেমানানও বটে! সচেতন দেশবাসী বিশ্বাস করতে চায়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত শিক্ষকদের চোখের জল, এসব গুণী উপদেষ্টাদের হৃদয়ের কম্পনকে বাড়িয়ে দেবার কথা। আর যদি তাই হয়, তবে তাঁদের কঠিন হুঁশিয়ারী বার্তা কোথায়? তাহলে কি জাতির অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম গুলোকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো তাঁদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না?
আমার বন্ধু স্বজনদের অনেকেই দেশের নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক। আমার শিক্ষকদের অনেকেই তো সর্বজন শ্রদ্ধেয়। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেও মনোনীত হয়েছেন। দল অন্তপ্রাণরা কিছুটা বেকায়দায় থাকলেও, দল নিরপেক্ষদের তো সুদিন! কি এমন ঘোর তাঁদের পেয়ে বসলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নৃশংসতম ঘটনাগুলো, এ গুণীদেরকেও সজাগ করছে না। আমরা কি তাহলে বোধশক্তি হারিয়ে ভিনগ্রহের মানুষ হয়ে উঠছি?
প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই ক্যাসিনো সম্রাটের কথা ভুলে যাননি? ঢাকা শহরে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আহুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমাদের মাথায় পঁচন ধরেনি, আঙ্গুলে পঁচন ধরেছিল, কেটে ফেলে দিয়েছি’। তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, সম্রাট আঙ্গুল সম মানুষ। তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আঙ্গুল কেটে ফেলে পঁচন থেকে রক্ষা পেয়েছেন। কথাটি কতটা ভ্রান্ত ছিল, ইত্তেফাকে প্রকাশিত গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে সালমান রহমানের তথ্যগুলোই তাঁর প্রমাণ। আসলে পঁচন মাথা থেকেই ধরেছিল, আঙ্গুল থেকে নয়। আর এটি ক্যান্সার হয়ে সারা জাতির গায়ে ছড়িয়েছে। আজকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোই তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
আমি ছাত্রদের দায়ী করতে চাই না। শিক্ষাঙ্গনে যা ঘটছে, তা কোন ভাবেই সমাজ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুর্নীতি, দুঃশাসন অর্থবৃত্তের মোহ সমাজকে বহু আগেই অন্ধকারে নিপতিত করেছে। লোভী, শাসক, রাজনীতিবিদদের বিত্তশালী হওয়ার প্রতিযোগিতায়, মানুষের চেয়ে অমানুষের কদর বেড়েছে। কলুষিত হয়েছে সমাজ। এ সমাজে বেড়ে উঠা তরুণ প্রজন্ম লক্ষ্মীপুরের স্মাগলার পিপলু, ঝিনাইদের চোরাচালানি আনারের কদর দেখেছে, ইউনুস সাহেবদের কদর দেখেনি। এ তরুণ প্রজন্ম ইয়াবা সম্রাট বদির সম্মান দেখেছে, শাস্তি দেখেনি! চোখের সামনে এস আলম, সালমান, বেনজিরদের দাপট দেখেছে, তাঁদের নত হওয়া দেখেনি। নোবেলজয়ীর সংবর্ধিত হওয়ার পরিবর্তে, পদ্মার পানিতে ছুবানোর গল্প শুনেছে! রাষ্ট্রের বিবেক গণমাধ্যম। এই গণমাধ্যমের তোষণ দেখেছে, বিবেক দেখেনি। সোনা মনিরের দান খয়রাত দেখেছে, মানুষ হওয়া দেখেনি!!
দূষিত আবর্জনায় ছেয়ে গেছে সমাজ।
এ সমাজকে কালিমা মুক্ত করতে হলে, প্রয়োজন বৈপ্লবিক সংস্কার। পারিবারিক বলয় আর সিন্ডিকেট মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশে সৎ মানুষের কর্তৃত্বকে বিকশিত করতে না পারলে, প্রত্যাশিত সংস্কার অসম্ভব। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী পরিস্থিতি নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। দাবি উঠছে নির্বাচনের! গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্বশর্ত, জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ। রাজনীতিবিদরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেবে, এটিই স্বাভাবিক রীতি। তবুও মানুষের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, একটি যথাযথ বৈপ্লবিক সংস্কার ছাড়া দেশবাসী গণতন্ত্রে ফিরতে নারাজ। ভোট নয়, মানুষ তৈরীর ব্যবস্থা চাই! এটিই যেন সময়ের দাবি হয়ে উঠছে!!
বিগত কয়েক যুগে দলীয়করণ ও অপ-রাজনীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সমাজ। যে শিক্ষকদের রাজনীতি করার কথা নয়, টিকে থাকার সংগ্রামে সেই শিক্ষককে ও রাজনীতি নিয়ে খেলতে হয়েছে। সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের আচার-আচরণ যেন রাজনীতিবিদদের হার মানিয়েছিল। এর সবকিছুর পেছনে মূলমন্ত্র হিসবে কাজ করেছে, ঠিকে থাকা আর প্রাপ্তির হিসাব নিকাশ। সেই হিসেব নিকেষে সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ, আইন-কানুন সব কিছুই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। আজকের শিক্ষাঙ্গনে আমরা যা দেখছি, তাঁর সবই সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ফসল। গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে রাজনীতিবিদদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উন্মত্ত প্রতিযোগিতার নির্যাস। বহুমুখী সংস্কারের আশা জাগানো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে, নৈতিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। কাউকে আইন হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ না নিয়ে, দুষ্কৃতকারী আর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।
Leave a Reply