সোমবার, ১৪ Jul ২০২৫, ০৫:২৪ অপরাহ্ন

যন্ত্রপাতি ক্রয়েই ৯ কোটি টাকা গায়েব

যন্ত্রপাতি ক্রয়েই ৯ কোটি টাকা গায়েব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ভবন বা ক্যাম্পাস কিছুই নেই। নেই শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিকেলের সঠিক যন্ত্রপাতি, শ্রেণিকক্ষ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক। এতে ডাক্তার হওয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে একেবারেই চিন্তিত ও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। আর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবায় কোনো সুফল পাচ্ছেন না জেলাবাসী। তবে এতসব না থাকলেও এ কলেজে আছে শুধু দুর্নীতি ও লুটপাট।
শুরুতেই শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে লুটপাট করা হয়েছে অন্তত ৯ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা ভাগবাটোয়ারা করে খেয়েছেন লুটপাটের সকল অর্থ। যদিও সে সময় এসব লুটপাটের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে মামলাও করেছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরকারদলীয় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতার হস্তক্ষেপে আলোর মুখ দেখেনি দুদকের মামলা। রাজনৈতিক জোরালো তদবীর ও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পার পেয়ে যান তৎকালীন অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান। প্রাথমিকভাবে তিনি সাময়িক বরখাস্ত হলেও পরে তদবীরের জোরে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে থাকেন স্বপদে। তবে বর্তমান বৈষম্যহীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে পূর্বের এসব পুকুর চুরির পুনঃতদন্তপূর্বক রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির দাবি শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের। এ ছাড়া ছাত্রদের আন্দোলনের তোপের মুখে পদত্যাগকারী কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ডা. সুনির্মল রায় ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। তাদের দুর্নীতির বিচারও চান শিক্ষার্থীরা।

সূত্র জানায়, হবিগঞ্জে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজটি ২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারি অনুমোদন লাভ করে। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১০ই জানুয়ারি কলেজটির আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। নিজস্ব জায়গা ও ভবন না থাকায় হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের একটি ভবনে কার্যক্রম শুরু হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার পরই জোর তদবীর ও অর্থের বিনিময়ে কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ নিয়োগপ্রাপ্ত হন ডা. আবু সুফিয়ান। অভিযোগ রয়েছে, যোগদানের পর থেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু জাহিরের শক্তির বলে কলেজে রাম রাজত্ব কায়েম করেন অধ্যক্ষ। এরপর শুরু হয় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ সময় কলেজের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে পুকুর চুরির ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে প্রায় ১৪ কোটি টাকার টেন্ডারের অর্ধেক টাকাই লুটপাট করেন অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীরা। যেসব জিনিস কেনা হয়েছে তার মূল্য ধরা হয় বাস্তব মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। দেশের সে সময়ের সরকার প্রধানের নামে মেডিকেল কলেজটি প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ধরাকে সরা করে চলতে থাকেন অধ্যক্ষ। কিন্তু একপর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এলাকাবাসী। গণমাধ্যমে এসব দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে তদন্তে নামে দুদকও। অনুসন্ধানে জানা যায়, মালামাল ক্রয় বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি ছিল না। সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ১১০ মডেলের ল্যাপটপের মূল্য দেখানো হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। অথচ বাজারে একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি মূল্য ছিল মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা। ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকার ইন্টারেক্টিভ বোর্ড কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। ৬ হাজার ৪শ’ ৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছিল ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা। এ ছাড়াও মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিক মডেলের মূল্য ধরা হয় ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা। যেগুলোর বাজার মূল্য ছিল অর্ধেকের চেয়েও কম। ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করা হয়। যার মূল্য ধরা হয় ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় দেখানো হয় ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ছিল দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকা, একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এরকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। বাজারমূল্য থেকে কয়েকগুণ বেশি দরে এসব যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী সরবরাহ করে ঢাকার নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ ও পুনম ট্রেড ইন্টার ন্যাশনাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করেন। পরে দুর্নীতির সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর কর্মস্থল থেকে আত্মগোপনে চলে যান অধ্যক্ষ সুফিয়ান। একপর্যায়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের একান্ত সহকারীর সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্কের কারণে তাকে দিয়ে তদবীর করিয়ে দুদকের মুখ বন্ধ করাতে সক্ষম হন অভিযুক্ত অধ্যক্ষ। একই ক্ষমতার বলে নিজের অধ্যক্ষ পদও টিকিয়ে রাখেন ডা. সুফিয়ান।

ডা. আবু সুফিয়ান অবসরে যাওয়ার পর কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ডা. সুনির্মল রায়। এরপর থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম। অনেকটা নামসর্বস্ব মেডিকেল কলেজ হিসেবে সীমিত আকারে ক্লাস চলে এ কলেজে। বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানে ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্ণ হতে চললেও এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি স্থায়ী ক্যাম্পাস। ৭৬টি শিক্ষকের পদের অনুমোদন থাকলেও কর্মরত আছেন ৪২ জন। শিক্ষকের ৩৪টি পদই রয়েছে শূন্য। কলেজে স্থায়ী কোনো ক্যাম্পাস না থাকায় নানা সমস্যায় পাঠ কার্যক্রম ব্যাঘাত ঘটছে বলে অভিযোগ শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের। যদিও কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবিদার সংসদ সদস্য আবু জাহিরের ক্ষমতার বলে হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের ২য় ও ৩য় তলায় সীমিত আকারে চলেছে শিক্ষা কার্যক্রম। অন্যদিকে সদর হাসপাতালে কলেজের কার্যক্রম চলায় রোগীদের জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আমিনুল হক সরকার জানান, হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও জেলা সদরের একমাত্র এ হাসপাতালটিতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে ৪শ’ থেকে ৫শ’ জন। হাসপাতালের দুটি তলায় মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করায় রোগীদের স্থান সংকুলানে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে স্থান সংকুলানের অভাবে কলেজের অনেক বিভাগের কার্যক্রমই রয়েছে বন্ধ। নেই শিক্ষার্থীদের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার কোনো স্থান। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথম পাঠদান শুরু হয়। ইতিমধ্যে কলেজটির প্রথম ব্যাচ বের হয়েছে। অথচ স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্লাসরুম নেই, হল নেই, ক্যান্টিন নেই, নেই সংস্কৃতি ও ক্রীড়াচর্চার কোনো ব্যবস্থাও। সীমিত আকারে চলে পাঠদান। ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষে চলে প্রশাসনিক কার্যক্রম। ক্লাসরুমের সংকটে শির্ক্ষার্থীদের অপেক্ষায় থাকতে হয়। ছোট ছোট কক্ষে চলে ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরির কার্যক্রম। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জানান, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ কলেজে ক্লিনিক্যাল শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ফলে শিক্ষকদের চেষ্টার পরও সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। কিছু ডিপার্টমেন্ট রয়েছে, যেগুলোতে কোনো শিক্ষকই নেই। অন্যদিকে স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় মেয়েদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে না। বর্তমানে শহর থেকে অনেকটা দূরে ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে যাতায়াতে প্রচুর সমস্যা হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হয় তাদের।
অভিযোগ রয়েছে, যোগদানের পর থেকেই পূর্বসূরির পথ ধরে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন অধ্যক্ষ ডা. সুনির্মল রায়। ২০২৩-২০২৪ এর অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন বরাদ্দ দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন অধ্যক্ষ। বিভিন্ন সময়ে এর প্রতিবাদ করলেও কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য আবু জাহিরের খুঁটির জোর ও মন্ত্রণালয়ে তদবীরের মাধ্যমে স্বপদে বহাল থাকেন অধ্যক্ষ নির্মল। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর অধ্যক্ষের দুর্নীতি ও নানা অনিয়ম নিয়ে জোরালো আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা প্রথমে অধ্যক্ষ ডা. সুনির্মল রায় ও একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর ডা. কান্তি প্রিয় দাশের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা সেবা, বিদ্যুৎ বিল, বইপত্র, জ্বালানি, ক্রীড়াসামগ্রী, রাসায়নিক সামগ্রী ক্রয়সহ বিভিন্ন খাত থেকে বছরে অন্তত ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ অভিযোগ করেন। তারা জানান, ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ওই দুই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। তাদের হল ত্যাগে বাধ্য করেন। অন্যথায় পুলিশ পাঠিয়ে হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেন। তাদের পলাতক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দোসর দাবি করেন শিক্ষার্থীরা।  বিদ্যুৎ, পানি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের হিসাব দিতে আল্টিমেটাম দেন তারা। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ কোনো সাড়া না দেয়ায় তাদের পদত্যাগের একদফা আন্দোলনে নামেন তারা। পরে শিক্ষার্থীরা কলেজের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে মঙ্গলবার (৩রা সেপ্টেম্বর) বিকাল ৫টার মধ্যে পদত্যাগ করতে আল্টিমেটাম দেয়। এরপরও পদত্যাগ না করায় ক্যাম্পাসের সামনে বিক্ষোভ, অবস্থান ধর্মঘট ও অধ্যক্ষের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রোববার (৮ই সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর এ পদত্যাগপত্র জমা দেন হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সুনির্মল রায়। এর পর থেকে অধ্যক্ষবিহীন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এ কলেজের কার্যক্রম। দ্রুত অধ্যক্ষ নিয়োগ ও স্থায়ী ক্যাম্পাসসহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে জেলাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com