স্টাফ রিপোর্টার ॥ নবীগঞ্জে ১৪৪ ধারা ভেঙে চার গ্রামের হাজারো মানুষের সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অন্তত ৫০টি দোকান এবং একটি বেসরকারি হাসপাতাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দাবি, এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংঘর্ষের এ ঘটনা ঘটে সোমবার (৭ জুলাই) বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে।
এতে অংশ নেন উপজেলার আনমনু, পূর্ব তিমিরপুর, পশ্চিম তিমিরপুর ও চরগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাবেক যুবলীগনেতা আশাইদ আলী আশা এবং নবীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সেলিম তালুকদারের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষের সূত্রপাত। ওইদিন সেলিম তালুকদারের শ্যালক খসরু মিয়া তালুকদারের সঙ্গে আশাইদ আলী আশার কথা কাটাকাটি। একপর্যায়ে তা মারামারিতে রূপ নেয়। সেই জেরে গত চারদিন নানাদিকে মোড় নেয় সংঘর্ষ। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, দুপুরের পর গাজীরটেক পয়েন্টে মুখোমুখি হয় দুপক্ষ। পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে গাজীরটেক, মৎস্যজীবী পাড়া, চরগাঁও ও পশ্চিম বাজার এলাকায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিকেল ৪টার দিকে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমীন ১৪৪ ধারা জারি করেন। তবে তা কার্যত অকার্যকর ছিল। সন্ধ্যা ৬টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। সংঘর্ষে নিহত হন তিমিরপুর গ্রামের ফারুক মিয়া (৪৫)। আহত অবস্থায় তাকে সিলেট নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয় বলে জানান ইউএনও রুহুল আমীন। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও একজন আহত ভর্তি রয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে গাজীরটেক, মধ্যবাজার, মাছবাজার, হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা এবং সিএনজি স্ট্যান্ড। হামলায় অন্তত ৫০টির বেশি দোকানে ভাঙচুর, ১০টির বেশি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং ইউনাইটেড হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে লুটপাট চালানো হয়। ইউনাইটেড হাসপাতালের মালিক মাহমুবুল আলম সুমন বলেন, তিমিরপুরের কিছু লোক সংঘর্ষের সময় হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রতিপক্ষ এসে সেখানেও হামলা চালায়, মারধর করে। অপারেশন থিয়েটারে আগুন দেয়, এক্সরে, আল্ট্রাসাউন্ড, হরমোন এনালাইজারসহ উন্নত যন্ত্রপাতি লুট করে। তিনি জানান, শুধু হাসপাতালেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টাকা। মধ্যবাজারে আগুনে পুড়ে যায় হাসেমবাগ হোটেল। আল নোহা হোটেলের মালিক সাজু আহমেদ জানান, কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার সময় হঠাৎ হামলা হয়। দোকান ভাঙচুর ও লুটে আমি নিঃস্ব,এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ব্যবসায়ী নেতা সুমন বলেন, এ হামলা পরিকল্পিতভাবে চালানো হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটির কম হবে না। দ্রুত জড়িতদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই। নবীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও নবীগঞ্জ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ছাবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষে নবীগঞ্জ শহরের দেড় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। হাসপাতাল-ক্লিনিকও রক্ষা পায়নি। অনুমান ১৫/২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রশাসন সংঘর্ষের প্রায় এক ঘণ্টা পর ১৪৪ ধারা জারি হয়। আগে করলে হয়তো এত বড় ক্ষতি হতো না। তবে নবীগঞ্জ ইউএনওর দেওয়া তথ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা ভিন্ন। তিনি জানান, প্রাথমিক হিসেবে ২৫টির বেশি দোকান ভাঙচুর ও অন্তত ১০টি দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অধিকাংশ দোকান ছিল মুদি ও নিত্য পণ্যের। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ইউএনও বলেন, সেনা মোতায়েন ও অতিরিক্ত পুলিশ দায়িত্বে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।
জাতীয়, স্থানীয় নানাবিধ সমস্যায় নবীগঞ্জের সর্বস্তরের জননেতাদের ঐতিহ্য মন্ডিত ভূমিকা ইতিপূর্বে বহুবার প্রমানিত হয়ে আসতে দেখাগেছে। কিন্তুু সাম্প্রতিক গত ৪ দিনের ওই নৈরাজ্যজনক ঘটনাবলীর পরও নবীগঞ্জের জ্ঞানীগুনী রাজনৈতিক, সামাজিক নের্তৃবৃন্দের ভূমিকা কি তা জনমনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আইনী কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে নানা রকম উদ্যোগ নিলেও কার্যত পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাধারন মানুষ শুধু আতংকগ্রস্থই নন, রীতিমত ভীতসন্ত্রস্থ। নবীগঞ্জের সচেতন নের্তৃবৃন্দ আন্তরিকতা নিয়ে, নবীগঞ্জের অতীত ঐতিহ্যে রক্ষায় এখনই মাঠে নামতে হবে। তাহলেই অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনা সহজতর হবে বলে নবীগঞ্জের ভূক্তভোগী মানুষ মনে করেন।
হবিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ঘটনার সময় আমাদের তিনটি ইউনিট কাজ করেছে। কর্মীরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালান। কিছু দোকান রক্ষা পেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নবীগঞ্জ শহর পরিদর্শনে মনে হয়েছে, ‘যেন কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ দেখছি।
Leave a Reply