মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ১১:১৮ অপরাহ্ন

ফিরে দেখা ২০২৪ বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন গুণী শিল্পী যারা চিরনিদ্রায় শায়িত

ফিরে দেখা ২০২৪ বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন গুণী শিল্পী যারা চিরনিদ্রায় শায়িত

বিজয় ডেস্ক ॥ ২০২৪ বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর ২০২৫। বিনোদন জগতের জন্য বছরটি ছিল বেশ ঘটনাবহুল। জীবনের ভ্রমণ শেষ করে এ বছরও বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন গুণী চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। কেউ রোগে ভুগে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন, আবার কারও মৃত্যু অন্য সবার কাছে ছিল আকস্মিক খবর। সবার মৃত্যু স্বজনদের যেমন শোকাতুর করেছে, ভাবিয়েছে ও কাঁদিয়েছে, তেমনি সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তদের বিষাদের সাগরে ডুবিয়েছে। তবে তারা বেঁচে থাকবেন কাজে, স্মৃতিতে। এ বছর বিভিন্ন অঙ্গনে যাদের হারিয়েছি, একনজরে তাদের দেখে নেওয়া যাক।
অভিনেতা আহমেদ রুবেল ঃ বছরের শুরুতেই মিডিয়াপাড়া ও ভক্তরা শোকে কাতর হয়ে পড়ে নন্দিত অভিনেতা আহমেদ রুবেলের মৃত্যুতে। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। ওইদিন সন্ধ্যায় বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে গাড়ি রেখে নিজের শেষ সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’-এর প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। গাড়ি থেকে নামার পর ফ্লোরে পড়ে যান এই অভিনেতা। এরপর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিজের শেষ সিনেমা মুক্তির একদিন আগে মারা যান এই অভিনেতা। মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন এই গুণী অভিনেতা। সেলিম আল দীনের ‘ঢাকা থিয়েটার’ থেকে আহমেদ রুবেলের অভিনয় যাত্রা শুরু হয়। তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘স্বপ্নযাত্রা’। উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে ‘বারোটা বাজার আগে’, ‘প্রতিদান’, ‘নবাব গুন্ডা’, ‘এফএনএফ’, ‘একান্নবর্তী’, ‘রঙের মানুষ’, ‘পাথর’, ‘অতল’, ‘চেয়ার’, ‘স্বর্ণকলস’, ‘আয়েশার ইতিকথা’, ‘দূরের বাড়ি কাছের মানুষ’, ‘সৈয়দ বাড়ির বউ’ ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘পোকা’য় অভিনয় করে দর্শকদের নজর কেড়েছেন এই অভিনেতা। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদের ‘অতিথি’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘বিশেষ ঘোষণা’, ‘সবাই গেছে বনে’, ‘বৃক্ষমানব’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’ এই নাটকগুলোতে রুবেলের অভিনয় প্রশংসিত হয়। ১৯৯৩ সালে ‘আখেরী হামলা’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় অভিষেক হয় আহমেদ রুবেলের। এরপর অভিনয় করেছেন ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘ব্যাচেলর’, ‘গেরিলা’, ‘দ্য লাস্ট ঠাকুর’, ‘অলাতচক্র’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায়।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ ঃ প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ ২০২৪ সালের ১৩ মার্চ মারা যান। অজানা এক অভিমানে আত্মহত্যা করেন এই গুণী সংগীতশিল্পী। সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে বেড়ে ওঠেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি। গানের প্রতি প্রবল টান থাকায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ১৯৭৬ সালে পাড়ি জমান শান্তিনিকেতনে। এরপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মাধ্যমে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি মহম্মদ। তার প্রথম অ্যালবাম ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। ২০০৯ সালে ‘শ্রাবণ আকাশে’ ও ২০১২ সালে ‘সার্থক জনম আমার’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ষাটের অধিক। সাদি মহম্মদকে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ প্রদান করে।
অভিনেতা অলিউল হক রুমি ঃ চলতি বছরের ২২ এপ্রিল আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা অলিউল হক রুমি মারা যান। মৃত্যুর আগে শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন এই অভিনেতা। ক্যানসার জয় করে আগের মতো অভিনয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেরা হয়নি তার। ১৯৬৪ সালের ২৪ অক্টোবর বরগুনায় জন্মগ্রহণ করেন রুমি। অভিনয়ে তিন দশকের বেশি সময় পার করেছেন এই অভিনেতা। এই দীর্ঘ সময়ে অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটক ও সিনেমায়। ১৯৮৮ সালে অভিনয়ের শুরু থিয়েটার বেইলি রোডের ‘এখনো ক্রীতদাস’ নাটকের মধ্য দিয়ে। একই বছর ‘কোন কাননের ফুল’ নাটকের মাধ্যমে টিভি নাটকে অভিষেক হয় তার। এই অভিনেতা টেলিভিশনের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। ২০০৯ সালে ‘দরিয়াপাড়ের দৌলতি’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন অলিউল হক রুমি। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাতে বেশি অভিনয় করতেন তিনি। তার আঞ্চলিক ভাষার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা। অভিনেতার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো– ‘বোকাসোকা তিনজন’, ‘মেকাপ ম্যান’, ‘ঢাকা টু বরিশাল’, চৈতা পাগল’, ‘জমজ সিরিজ’, ‘ঢাকা মেট্রো লাভ’, ‘জার্নি বাই বাস’, ‘রতনে রতন চিনে’, ‘আমেরিকান সাহেব’, ‘বাকির নাম ফাঁকি’, ‘কমেডি ৪২০’, ‘জীবনের অলিগলি’ ইত্যাদি।
ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ ঃ জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ চলতি বছর ২৫ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। শাফিন আহমেদ স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। কনসার্টে অংশ নিতে ব্যান্ড সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যান শাফিন। ২০ জুলাই শাফিনের একটা কনসার্ট ছিল ভার্জিনিয়ায়। শো এর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন শাফিন। এ কারণে শো বাতিল করেন তিনি। সেদিনই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর তার নানা অর্গান অকার্যকর হতে থাকলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এরপর তাকে আর ফেরানো যায়নি।
শাফিন আহমেদের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মা কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী ফিরোজা বেগম এবং বাবা সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্ত। এই পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই শাফিন আহমেদ গানের ভেতরেই বড় হন। শৈশবে বাবার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছেন আর মায়ের কাছে শিখেছেন নজরুলসংগীত। এরপর বড় ভাই হামিন আহমেদ সহ যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার সুবাদে পাশ্চাত্য সংগীতের সংস্পর্শে এসে ব্যান্ডসংগীত শুরু করেন। দেশে ফিরে গড়ে তোলেন মাইলস। যা দেশের শীর্ষ ব্যান্ডের একটি এখনো। এই ব্যান্ডের ৯০ ভাগ গান শাফিন আহমেদের কণ্ঠে সৃষ্টি হয়েছে। পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। তিনি কণ্ঠের পাশাপাশি ব্যান্ডটির বেজ গিটারও বাজাতেন। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি ব্যক্তিগত কারণে মাইলস ছাড়েন শাফিন আহমেদ এবং রিদম অব লাইফ নামে নতুন একটি ব্যান্ডদল প্রতিষ্ঠা করেন। শাফিন আহমেদের গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে রয়েছে ‘আজ জন্মদিন তোমার’ ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘জ্বালা জ্বালা অন্তরে’, ‘ফিরিয়ে দাও হারানো প্রেম’, ‘ফিরে এলে না’, ‘হ্যালো ঢাকা’, ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’ প্রভৃতি। তিনি তার বাবা কমল দাশগুপ্তের কিছু গান নিয়েও একক অ্যালবাম করেছিলেন। মাঝখানে কিছু দিন রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থীও হয়েছিলেন।
সংগীত শিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল ঃ ১৩ বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে। শেষ পর্যন্ত ৩০ জুলাই সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। জুয়েলের বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। তার জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। তিনি স্ত্রী ও এক কন্যাসন্তান রেখে গেছেন। ২০১১ সালে তার লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর ফুসফুস এবং হাড়েরও ক্যানসার সংক্রমিত হয়। ৩০ জুলাই রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখান থেকেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই সংগীতশিল্পী। ব্যান্ড সংগীত যখন তুমুল আলোচনায়, ঠিক তখনই ব্যতিক্রমী কণ্ঠ নিয়ে হাজির হন শিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। ব্যাংকার বাবার চাকরির কারণে ছোটবেলায় তাকে থাকতে হয়েছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মা-বাবার অনুপ্রেরণাতেই গানের জগতে পা রাখেন জুয়েল। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রতিবেশী একজনের কাছে গান শিখেছিলেন আর মঞ্চে প্রথম গান করেছিলেন তখন তিনি পড়েন চতুর্থ শ্রেণিতে। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চলে আসেন জুয়েল। এসেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকেন্দ্রিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন। তখনই বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটতে শুরু করে।
জুয়েলের প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘এক বিকেলে (১৯৯৪)’, ‘আমার আছে অন্ধকার’ (১৯৯৫), ‘একটা মানুষ’ (১৯৯৬), ‘দেখা হবে না’ (১৯৯৭), ‘বেশি কিছু নয়’ (১৯৯৮), ‘বেদনা শুধুই বেদনা’ (১৯৯৯), ‘ফিরতি পথে’ (২০০৩), ‘দরজা খোলা বাড়ি’ (২০০৯) এবং ‘এমন কেন হলো’ (২০১৭)। একটি করে গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আরও দুটি অ্যালবাম ‘তাতে কি বা আসে যায়’ (২০১৬) এবং ‘এই সবুজের ধানক্ষেত’ (২০১৬)। ১০টি একক অ্যালবামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘এক বিকেলে’ অ্যালবামটি। এটি প্রকাশের পর তার নাম হয়ে যায় ‘এক বিকেলের জুয়েল’। জুয়েল একই সঙ্গে সংগীতশিল্পী, টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, আর্থিক ও মনের কথা বিবেচনা করে তিনি তার পেশাকে দুটো ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। গান করতেন হৃদয়ের টানে। শিল্পী জুয়েল হিসেবে পরিচিত হতেও পছন্দ করতেন। তাই গান করার সময় যাতে আর্থিক টানাপোড়েনে পড়তে না হয়, সে জন্য আরেকটি পেশা বেছে নিয়েছিলেন।
অভিনেতা আলাউদ্দিন লাল ঃ চলতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর উত্তরার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা আলাউদ্দিন লাল। ২০০৮ সাল থেকে তার অভিনয় জীবনের শুরু। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ নাটকে অভিনয় করেছেন আলাউদ্দিন লাল। জানা গেছে, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিকসহ নানাবিধ জটিলতায় ভুগছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন আলাউদ্দিন লাল। তবে এই প্রথম না, ২০২২ সালেও শ্বাসকষ্টের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অভিনেতাকে। সেসময় অর্থাভাবে অনিশ্চয়তার পড়েছিল তার চিকিৎসা। তবে কয়েকজন সহকর্মীর চেষ্টাতেও আলাউদ্দিন লালের চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। অভিনেতার এমন খবর শুনে পাশে দাঁড়ান মুশফিক আর ফারহান। সেসময় আলাউদ্দিনের চিকিৎসার সব খরচ একাই বহন করেছিলেন। পরে সুস্থ হয়ে কাজেও ফিরেছিলেন এই অভিনেতা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীতযোদ্ধা সুজেয় শ্যাম ঃ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগীতযোদ্ধা, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম মৃত্যুবরণ করেন ১৭ অক্টোবর। ১৯৪৬ সালের ১৪ মার্চ সিলেটে সুজেয় শ্যামের জন্ম। এই গুণী সংগীতশিল্পীর সুর করা গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি’, ‘আয় রে চাষি মজুর কুলি’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ এবং ‘শোন রে তোরা শোন’। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে একুশে পদক এবং এর আগে ২০১৫ সালে পান শিল্পকলা পদক।
কন্ঠশিল্পী মনি কিশোর ঃ চলতি বছর অক্টোবরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ৯০ দশকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর। ১৯ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মনি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও, টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। সিনেমায়ও তেমন গাননি। মূলত অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তারই সুর করা, তারই লেখা। ২০টির মতো গান লিখেছেন ও সুর করেছেন মনি কিশোর।
অভিনেতা মাসুদ আলী খান ঃ বরেণ্য অভিনেতা মাসুদ আলী খান মারা যান চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। এই অভিনেতা ১৯২৯ সালের ৬ অক্টোবর মানিকগঞ্জের পারিল নওধা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। দুই বছর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জগন্নাথ কলেজ) থেকে বিএ পাস করেন। মাসুদ আলী খানের অভিনয়ের শুরুটা হয় মঞ্চ নাটকের মধ্যামে। ১৯৫৬ সালে দেশের প্রথম নাটকের দল ‘ড্রামা সার্কেল’-এর সঙ্গে যুক্ত হন মাসুদ আলী খান। ১৯৬৪ নূরুল মোমেনের নাটক ‘ভাই ভাই সবাই’ নাটকে অভিনয়ে মধ্য দিয়ে ছোট পর্দায় তার অভিষেক হয়। পাঁচশোরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনীত আলোচিত কয়েকটি নাটক হচ্ছে ‘কূল নাই কিনার নাই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’। বড় পর্দায় তার অভিষেক হয় ‘নদী ও নারী’ সিনেমায় মাধ্যমে। তার অভিনীত কয়েকটি সিনেমা ‘দুই দুয়ারি’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘মাটির ময়না’, ‘জোনাকীর আলো’, ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’। ২০২৩ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য মাসুদ আলী খান পেয়েছেন একুশে পদক। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক ছাড়াও পান আরও অনেক পুরস্কার।
অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন ঃ দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর ১০ নভেম্বর মারা যান ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে তা মেরুদণ্ড থেকে হাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালে তার ক্যানসার শনাক্ত হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে মুম্বাইতেও নেওয়া হয়েছিল। জনপ্রিয় অভিনেতা ও অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এই শিল্পীকে ১ লাখ টাকা সহযোগিতা করেছিলেন। আফরোজা বিনোদন অঙ্গনের পরিচিত মুখ। তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেন টেলিভিশন নাটক দিয়ে। পরে তিনি চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। ১৯৯০-এর দশকে তার অভিনীত সিনেমাগুলি দর্শকমহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। সর্বশেষ ‘আবার বসন্ত’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।
গীতিকার ও সুরকার আবু জাফর ঃ বছরের শেষের দিকে আমরা হারাই বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও শিক্ষক আবু জাফরকে। তিনি মারা যান গত ৫ ডিসেম্বর। আবু জাফর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আবু জাফর রাজশাহী ও ঢাকা বেতার এবং টেলিভিশনের নিয়মিত সংগীতশিল্পী ও গীতিকার ছিলেন। আবু জাফর ছিলেন একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। চুয়াডাঙ্গা কলেজ ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। একাধিক কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। এর মধ্যে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’, ‘আমি হেলেন কিংবা মমতাজকে দেখিনি’, ‘তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি’ উল্লেখযোগ্য গান। ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ এই গানটি বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। তার রচিত দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গান বাংলা সংগীতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে। গীতিকার, সুরকার, শিক্ষক এই পরিচয়ের বাইরে তার আরেকটা পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন কবি। বেশ কিছু কবিতার বই লিখেছেন আবু জাফর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নতুন রাত্রি পুরোনো দিন’, ‘বাজারে দুর্নাম তবু তুমিই সর্বস্ব’, ‘বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা’ (অনুবাদ কাব্য)।
রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সরোয়ার ঃ বছরের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান একুশে পদকজয়ী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। গত ১২ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান গুণী এই শিল্পী। পাপিয়া সারোয়ারের জন্ম বরিশালে, ১৯৫২ সালে ২১ নভেম্বর। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্র অনুরাগী পাপিয়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছায়ানটে ভর্তি হন। পরে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সাল থেকে বেতার ও টিভিতে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে গান করেন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসংগীতে ডিগ্রি নিতে ভারতে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই প্রথম ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানে স্নাতক করার সুযোগ পান। তার আগে তিনি ছায়ানটে ওয়াহিদুল হক, সানজীদা খাতুন ও জাহেদুর রহিমের কাছে গানের দীক্ষা নেন। তার প্রথম অডিও অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। অ্যালবামটির নামও ছিল শিল্পীর নামেই, ‘পাপিয়া সারোয়ার’। তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘আকাশপানে হাত বাড়ালাম’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারে রবীন্দ্রসংগীতের জন্য কোটি শ্রোতার ভালোবাসা পাপিয়া সারোয়ার পেয়েছেন। তার ব্যতিক্রমী কণ্ঠ এবং গায়কির প্রশংসা ছিল সংগীতাঙ্গনে। আধুনিক গানেও আছে তার সাফল্য। ‘নাই টেলিফোন নাই রে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম’ গানটি তাকে আপামর বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। পাপিয়া সারোয়ার ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন। ২০২১ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। পাপিয়া সারোয়ার জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালে ‘গীতসুধা’ নামে একটি গানের দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বরেণ্য এই সংগীতশিল্পী।
চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান ঃ ‘উজান ভাটি’ খ্যাত দেশের বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান মারা গিয়েছেন ২০ ডিসেম্বর। চলতি মাসে হার্ট অ্যাটাকের পর থেকেই আইসিইউতে ছিলেন তিনি। সি বি জামান তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘ঝড়ের পাখি’, ‘উজান ভাটি’, ‘পুরস্কার’, ‘কুসুম কলি’সহ বেশ কয়েকটি প্রশংসিত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন।
গিটারিস্ট মিনহাজ আহমেদ পিকলু ঃ বছরের শেষে ২০ ডিসেম্বর মারা যান রকস্ট্রাটা ও অর্থহীন ব্যান্ডের সাবেক গিটারিস্ট মিনহাজ আহমেদ পিকলু। তিনি ছিলেন কিংবদন্তি গিটারিস্ট নিলয় দাশের শিক্ষার্থীদের অন্যতম। জানা গেছে, ২০ ডিসেম্বর রামপুরায় একটি অনুষ্ঠানে গিটার বাজাচ্ছিলেন পিকলু। সেখানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গিটারিস্ট পিকলু আশির দশকের মাঝামাঝিতে হার্ডরক জনরার ব্যান্ড রকস্ট্রাটা ও জলি রজারসে গিটার বাজাতেন। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে কিছুদিন তিনি ওয়ারফেজ ব্যান্ডে যোগ দেন। পরে ১৯৯৯ সালে অর্থহীন ব্যান্ডে যোগ দেন পিকলু। অর্থহীনের ‘রাতের ট্রেন’, ‘গুটি ফ্রম হেল’, ‘নির্বোধ’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গানে গিটার বাজিয়েছেন তিনি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com