সোমবার, ১৪ Jul ২০২৫, ০৮:১২ অপরাহ্ন

নির্যাতনে চার দাঁত হারানো গৃহকর্মী কল্পনা এবার হাসিমুখে বাড়ি ফিরবে

নির্যাতনে চার দাঁত হারানো গৃহকর্মী কল্পনা এবার হাসিমুখে বাড়ি ফিরবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৩ বছর বয়সী কল্পনার মুখে ঝকঝকে দাঁত, আর মুখে হাসি লেগেই আছে। লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় সে। এখন আর ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে কল্পনার হাসিমুখের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে।
অথচ আজ থেকে ৩ মাস ১১ দিন আগে কল্পনার চেহারা দেখে যে কেউ আঁতকে উঠতেন। কল্পনার সামনের চারটি দাঁত ভাঙা ছিল। হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিল ছ্যাঁকার ক্ষত। কোনো কোনো ক্ষত ছিল দগদগে। বুক, পিঠসহ সারা শরীরে মারের চিহ্ন। রক্ত শূন্যতার পাশাপাশি মানসিক ট্রমা তো ছিলই। কল্পনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের অধীনে চিকিৎসাধীন। এই চিকিৎসক জানান, দুই এক দিনের মধ্যেই কল্পনা হাসিমুখে বাড়িতে ফিরবে। কল্পনার শরীরে অনেকগুলো অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। কৃত্রিমভাবে চারটি দাঁত লাগানো হয়েছে। দাঁতগুলো স্থায়ীভাবে লাগানোর প্রক্রিয়া চলছে। নিচের ঠোঁটেও ছোট একটি অস্ত্রোপচার লাগবে। সব মিলিয়ে তাকে ফলোআপে রাখা হবে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় সাড়ে চার বছর গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত কল্পনা। সেখানেই সে চরম নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। বেসরকারি চ্যানেল ৭১ টেলিভিশনের সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমন একটি ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে কল্পনার বিষয়টি জানতে পারেন। পরে তাঁর মাধ্যমে ভাটারা থানার পুলিশের সহায়তায় ১৯ অক্টোবর রাতে বসুন্ধরার ওই বাসা থেকে কল্পনাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কল্পনা জানিয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে তাকে মারধর করার পাশাপাশি দিনে এক বেলা খাবার দেয়া হতো। চুল সোজা করার যন্ত্র দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া, লম্বা বেত দিয়ে মারধর করা এবং বন্দী করে রাখা হয়েছিল। মা ফোন করলেও ফোনের সামনে বাড়ির মালিক দিনাত জাহান থাকতেন বলে কল্পনা মাকেও নির্যাতনের কথা বলতে পারত না। কল্পনারা পাঁচ বোন ও এক ভাই। কল্পনার বাবা শরিফ মিয়া সিলেটের হবিগঞ্জে লাখাই উপজেলার সজন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তবে মেয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী আফিয়া বেগম তিন মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালেই ছিলেন। মেয়েকে মারধরের অভিযোগে আফিয়া বেগম বাদী হয়ে বাড়ির মালিক দিনাত জাহানের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় মামলা করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী মামলা করেন। দিনাত জাহান ও তাঁর এক ভাই বর্তমানে কারাগারে আছেন। গত বুধবার মুঠোফোনে কল্পনার মা আফিয়া বেগম বলেন, ‘মাইয়াডারে কামে দিয়া সর্বনাশ হইছে। মাইয়ারে আর কামে দিমু না। বাড়িত নিয়া ইস্কুলে ভর্তি করামু।’ পরে মায়ের মুঠোফোনেই কল্পনার সঙ্গে কথা হয়। শুরুতেই কেমন আছো, জানতে চাইলে কল্পনা জানায়, সে ভালো আছে। নিজে থেকেই প্রতিবেদককে ‘আপনি কেমন আছেন’ তাও জানতে চায়। টুকটুকে লাল লিপস্টিক দেওয়া কল্পনার হাসিমুখের ছবিটি খুব সুন্দর হয়েছে বললে সে হাসতে থাকে। জানায়, লিপস্টিকটি বড় বোন রত্না কিনে দিয়েছেন। বাড়িতে ফিরে স্কুলে ভর্তি হবে এবং পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক হবে বলেও জানিয়ে দিল সে। সে নির্যাতনকারী দিনাত জাহানের ফাঁসি চায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কল্পনাকে দেখতে গিয়েছিল। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ কল্পনাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তাঁর সুচিকিৎসার পাশাপাশি অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, মেয়েটির মা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলার আসামি হিসেবে দিনাত জাহান এবং সহযোগী অপরাধী হিসেবে তাঁর এক ভাই বর্তমানে কারাগারে আছেন। মেয়েটির মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার পর মামলার নিষ্পত্তি করা হবে। কল্পনার চিকিৎসক বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বলেন, ‘কল্পনা হাসিমুখে বাড়িতে ফিরছে, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।’ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পরে উপদেষ্টার সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কল্পনার সার্বিক অবস্থার কথা জানানো হয়েছে। উপদেষ্টা তাঁর মন্ত্রণালয়কে কল্পনার পড়াশোনাসহ পুনর্বাসনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর ক্ষত জায়গার সংক্রমণ এড়াতে কল্পনার শরীর ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছিল। মানুষের ভিড় থেকে দূরে রাখতে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) রাখতে হয়েছিল তাকে। তার শরীরের অনেকগুলো অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় চামড়া লাগাতে হয়েছে। হাসপাতালের দন্ত বিভাগ, মানসিক বিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে কল্পনার চিকিৎসা চলে। সরকারি খরচে তার চিকিৎসা হয়েছে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন জানান, কল্পনার শরীরে এখন শুধু অস্ত্রোপচারের দাগ আছে। আগে যে ট্রমা ছিল, তা এখন নেই বললেই চলে। কল্পনাও টেলিফোনে বলে, সে এখন আর মানুষ দেখে ভয় পায় না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com