রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহ’র বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার দূর্নীিতর অভিযোগ

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহ’র বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার দূর্নীিতর অভিযোগ

স্টাফ  রিপোর্টার ॥ এমপিওভুক্তির আবেদনের ফাইল পাঠাতে সর্বনিন্ম ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ, এনটিআরসিএ’র বহির্ভূত পদে (প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধান ও কর্মচারী) নিয়োগের ডিজি প্রতিনিধি (মাউশি মহাপরিচালকের প্রতিনিধি) দিতে ২০ হাজার টাকা, এভাবে টাইমস্কেল, উচ্চতর গ্রেড থেকে শুরু করে প্রতিটা ফাইলের জন্য ফি নির্ধারণ করে রমরমা ঘুষ বাণিজ্যে মেতে উঠা হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহ এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম) পদ থেকে সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদন্নোতি বাগিয়ে ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদায়ন নিয়ে এবং পরবর্তীতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদন্নোতি নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে হবিগঞ্জের ৮০ জন প্রধান শিক্ষক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে একাধিক অভিযোগ দিলেও সে অভিযোগ অন্ধকারেই রয়ে গেছে।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদ রুহুল্লাহ ১৯৯১ সালে সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম) পদে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যোগদানের এক বছর পরেই মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পদায়ন বাগিয়ে নিয়ে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধানমন্ডির গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ২০১০ সাল পর্যন্ত পদায়ন ছিলেন। ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে চলতি দায়িত্বের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন বাগিয়ে নিয়ে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৮ সালে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়ে হবিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়ন নেন এবং ২০২২ সালে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নোতি নিয়ে একই জেলায় কর্মরত রয়েছেন। মোহাম্মদ রুহুল্লাহর কর্মজীবনের ৩৩ বছরের মধ্যে প্রথম ২৫ বছর রাজধানী ঢাকায় এবং ৮ বছর ধরে হবিগঞ্জ জেলা সদরে রয়েছেন। হবিগঞ্জের জেলা শিক্ষা অফিসে যোগদান করার পর থেকেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। নামে বেনামে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার সম্পদ। দুদক অনুসন্ধান করলেই তার সত্যতা বেরিয়ে আসবে। এমপিওভুক্তির আবেদনের ফাইল, টাইমস্কেল, ডিজি প্রতিনিধি মনোনয়ন থেকে শুরু করে সব কিছুইতেই ‘ঘুষের রেট’ নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তিনি। হবিগঞ্জ জেলার বেসরকারি মাধ্যমিকের প্রায় ৮০ জন প্রধান শিক্ষক তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে ২০২০ সালে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি সে অভিযোগ আমলে না নিলেও হবিগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক তা আমলে নিয়ে তদন্ত করেন। তদন্তে এমপিওভুক্তিতে ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয় এবং জেলা প্রশাসক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন। তবে সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ করা হলেও তা না করে ২০২২ সালে তাকে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি প্রদান করা হয়। এতে জেলার শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হবিগঞ্জের অন্তত পাঁচ জন প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা অভিযোগ দিলেও মন্ত্রণালয় কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি ডিসির তদন্তে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে পদন্নোতি দিয়েছেন। তারা জানান, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি আরও বেপড়োয়া হয়ে উঠেছেন।

হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসে এখন কোন নিয়ম নেই, অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ফাইল নাড়াচাড়া করতেই টাকা দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়েও কাজ হয় না। তার থেকে পরিত্রাণ চান জেলার সকল শিক্ষক-কর্মচারীরা। ঘুষ বাণিজ্য তদন্তে প্রমাণের পরেও সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ রুহুল্লাহ।
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের তদারকি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্ণার স্থাপণ করে এবং কয়েকটি জাতীয় গণমাধ্যমে জেলা শিক্ষা অফিসের ছাদে করা ছাদ বাগানের সংবাদ পরিবেশন করে ২০২৩ সালে সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা শিক্ষা অফিসারের পুরষ্কার বাগিয়ে নেন মোহাম্মদ রুহুল্লাহ। অথচ তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের অক্টোবরে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের তদন্তে ঘুষ বাণিজ্য প্রমাণিত হওয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলেও তা আমলে না নিয়ে বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা শিক্ষা অফিসারের খেতাব দেওয়া হয়। জেলার প্রায় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দিলেও সেগুলোর কোন কর্ণপাত করা হয়নি। ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান’কে নিয়ে লিখে শেখ হাসিনার দৃষ্টি গোচর হয়েছিলেন তিনি। একাডেমিক জীবনে সকল ডিগ্রিতে ২য় শ্রেণি পাওয়া মোহাম্মদ রুহুল্লাহ ক্ষমতার উৎস কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হবিগঞ্জের সদর আসনের আওয়ামী লীগের (২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত) সাবেক সাংসদ আবু জাহিরের সঙ্গে ঘনিষ্টতায় তিনি ২০১৬ সালে হবিগঞ্জে পদায়ন বাগিয়ে নেন। এরপর সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে এবং জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি নিয়ে হবিগঞ্জেই কর্মরত আছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালে চলতি দায়িত্বের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে, ২০১৮ সালে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি এবং ২০২২ সালে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি বাগিয়ে নিতে এমপি জাহিরের সুপারিশ নেন তিনি। একই সময়ে যোগ্য ব্যক্তিরা পদন্নোতি বঞ্চিত হলেও তিনি পদন্নোতি বাগিয়ে নেন পতিত সরকারের শাসনামলে। তার বিরুদ্ধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অর্ধশত অভিযোগ জমা থাকলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। মাউশির মাধ্যমিক শাখার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন এবং একই শাখার সহকারী পরিচালক দূর্গা রানী সিকদার মোহাম্মদ রুহুল্লাহ বিরুদ্ধে যত অভিযোগই উঠুক না কেন সেই ফাইল আর কর্ম তালিকায় উঠাননি। এছাড়াও মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক কর্মকর্তা রুহুল্লাহর ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায় মন্ত্রণালয়ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিকের যুগ্মসচিব কাজি মোঃ আবদুর রহমান, উপসচিব মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার, এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু আলম রুহুল্লাহকে ঢাকার ডিডি পদে পদায়নের জন্য সরাসরি কাজ করছেন। এই সিন্ডিকেটে শিক্ষা ভবন সহ ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের জন্য তালিকায় রয়েছেন ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মজিদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ ইউনুছ ফারুকী এবং তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহরীন খান রুপা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নিকট প্রায়ই দৌড়ঝাঁপ করছেন রুহুল্লাহ। উদ্দেশ্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কোন পদ। আওয়ামী লীগের আমলের সুবিধাভোগী মোহাম্মদ রুহুল্লাহ নিজেকে আওয়ামী লীগের আমলের বঞ্চিত কর্মকর্তা সাজিয়ে পদন্নোতি নিতে নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে ঘুরছেন। তাকে পদায়নের জন্য মন্ত্রনালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও কাজ করছেন বলে সূত্র মারফত নিশ্চিত হওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহর মুঠোফোনে কল করলেও নম্বরটিতে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) ড. খ ম কবিরুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, পতিত সরকারের এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনও স্বপদে বহাল দেখে আশ্চর্য হই। অযোগ্য হয়েও যোগ্যদের বঞ্চিত করে পদন্নোতি বাগিয়ে নেয়া এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। নতুবা শিক্ষায় পতিত সরকারের রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্তরণ করা যাবে না।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com