স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন বানিয়াচং থানায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা থানায় আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করে সেদিন। এতে পুলিশের ৫৪ সদস্য থানার ভেতর অবরুদ্ধ থাকেন। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদের উদ্ধার করা হয়। ওই উদ্ধার অভিযানে ছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আমিনুল ইসলাম এবং উপপরিদর্শক মো. মাহমুদুল হাসান। জনরোষে পড়া পুলিশ কর্মকর্তা মাহমুদুলকে ‘বাঁচাতে গিয়ে’ সংঘর্ষে জড়ান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলামও। এ বছর অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহ-২০২৪-এ ওই দুই কর্মকর্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে পদক পেয়েছেন। অসীম সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম এবং সাহসিকতা ও প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পান মাহমুদুল। শুধু পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তাই নন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে ‘অসীম সাহসিকতা ও প্রশংসনীয় কাজের’ জন্য পুলিশের অন্তত ৭ সদস্য পদক পেয়েছেন। বছর জুড়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাহসিকতা ও প্রশংসনীয় কাজের জন্য পুলিশ বাহিনীতে বিপিএম ও পিপিএম পদক দেওয়া হয়। এই পদক পেতে নিজের কাজের বিষয় উল্লেখ করে নিজ নিজ ইউনিট প্রধানের মাধ্যমে আবেদন করার রেওয়াজ রয়েছে। তবে এবার আবেদন ছাড়াই পুলিশ পদক পেয়েছেন অন্তত ২৩ সদস্য। যদিও সরকার পতনের পর গত বছরের ১৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার যাত্রা শুরু হয়। ছাত্র ও জনগণ এটিকে সফল করার জন্য আন্দোলনের ভিত্তিতে সক্রিয়ভাবে এর জন্য কাজ করেছে; ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চলা গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না।’ তবে ৫ আগস্টের ঘটনায় পুলিশকে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য পুরস্কৃত করায় প্রশ্ন উঠছে, একদিকে ঘটনার দায়মুক্তি, আবার একই ঘটনায় সাহসী, বীরত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এতে কি ভবিষ্যতে প্রতীয়মান হবে না যে, আন্দোলনকারীরা সেসময় অপরাধ করেছে? এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, এটা আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি দায়মুক্তি দেওয়া হয় তাদের কর্মকাণ্ডের, তাহলে আবার পদক দেওয়া কেন? ওই সময়কার ঘটনাগুলোকে তো আলাদা করে চিহ্নিত করার ব্যাপার আছে এখানে। আমরা যেটা প্রশ্ন তুলছিলাম যে, কে দোষী কে নির্দোষ। কে জড়িত ছিলেন, কে ছিলেন না। সেই জিনিসটা চিহ্নিত করা খুব জরুরি ছিল সে সময়। তিনি বলেন, আমার মনে হয় এ ধরনের পদক দেওয়ার আগে সাধারণ নাগরিকদের কাছে এটা পরিষ্কার করা খুবই জরুরি ছিল যে, তারা (পদকপ্রাপ্তদের যারা নির্বাচন করছেন) কে কোন ঘটনায় জড়িত ছিল আর কে ছিল না নিশ্চিত হয়েছেন। ধরুন, অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো, যাদের পদক দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন জড়িত ছিল আন্দোলন দমন-হত্যায়, তাহলে তো রাষ্ট্রীয় পদকের পুরো বিষয়টিই মকারিতে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে এটাকে দেখিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্তদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এ রকম আইনের মারপ্যাঁচ আছে। এবারের পুলিশ সপ্তাহ শুরু হয় গত ২৯ এপ্রিল। নানা সেমিনার ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা ১ মে শেষ হয়। অনুষ্ঠানের শুরুর দিন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশের ৬০ সদস্যকে পদক পরিয়ে দেন। ২০২৪ সালের পেশাগত দায়িত্ব পালনে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজ এবং অন্যান্য প্রশংসনীয় কাজের জন্য বিপিএম পদক পান ১৪ জন, বিপিএম সেবা পদক পান ১৩ জন, পিপিএম পদক পান ১৩ জন এবং পিপিএম সেবা পদক পান ২০ জন সদস্য। পদকপ্রাপ্তরা এককালীন হিসেবে এবং মাসিক বেতনের সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে টাকা পেয়ে থাকেন। পুলিশ বাহিনীতে কর্মজীবনে এই পদককে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানায় সেদিনের ঘটনায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত আন্দোলনকারী, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র প্রতিনিধি আর প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে । তাদের বয়ানে উঠে এসেছে ঘটনার ভিন্ন চিত্র। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আন্দোলকারীরা বলছেন, সেদিন পুলিশ মারমুখী ভূমিকায় ছিল। যারা পুলিশকে রক্ষা করতে এসেছিলেন, মূলত তারা আন্দোলনকারীদেরই আক্রমণ করেছেন। সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, ‘সেদিন বানিয়াচং থানা পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের ঘটনায় ৯ জন নিহত হওয়ার খবরে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা বানিয়াচং থানা ঘেরাও করে আগুন দেন। অবরুদ্ধ হয়ে থানার দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নেয় ৫৪ জন পুলিশ। তাদের উদ্ধার করে নিরাপদে পৌঁছাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে সেনাবাহিনীর একাধিক টিম ও স্থানীয় বিএনপিসহ ছাত্র প্রতিনিধি ও আলেম সমাজ।’ আবেদন ছাড়া পদক পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, ‘আবেদন করতে হয় না। আবেদন না করলেও আমরা বিচার-বিবেচনা করে দিই। যারা আবেদন করেছে, আমরা তাদেরটাও বিবেচনা করে দিয়েছি। যারা করেনি তাদেরটাও আমরা দিয়েছি। যে ছেলেটা রাস্তায় বাড়ি দিয়ে ভীতি সৃষ্টি করে মিছিল তাড়িয়েছে, সে তো কোনো আবেদন করে নাই। তাকেও তো আমরা পদক দিয়েছি।’ পদকের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, শুধু রাজারবাগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ বিবেচনায় এবার পদক পেয়েছেন তৎকালীন আইজিপি মো. মইনুল ইসলাম, ঘটনার সময়ে রাজারবাগ পুলিশ টেলিকমে দায়িত্বরত অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান, বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসফিকুজ্জামান আকতার, অ্যাডিশনাল আইজিপি আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ও ডিএমপির উপকমিশনার রওনক আলম এবং সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ। অবশ্য আবেদন ছাড়া বিশেষ ব্যবস্থায় এভাবে পদক দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে এরকম হতে পারে। রাজনৈতিক বিবেচনায় তদবির করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পছন্দের লোক কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের লোক পদক পেয়ে যায়। তবে নিয়ম অনুযায়ী আবেদন না করে পদক পাওয়ার সুযোগ নেই। এখন তো কোনো রাজনৈতিক সরকার নেই। এই সময় এমনটা হবে না, সেটাই আমরা প্রত্যাশা করব।’
Leave a Reply