বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের দিন সংঘর্ষ, থানায় হামলা, পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীর মৃত্যুর পর সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর ‘পুলিশ হত্যা’র দাবি নিয়ে দর–কষাকষির এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। ওই দিন বিক্ষুব্ধ লোকজন বানিয়াচং থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্র লুট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং অর্ধশতাধিক পুলিশকে অবরুদ্ধ করা হয়। এর আগে সেখানে পুলিশের গুলিতে অন্তত নয় গ্রামবাসী নিহত হয়। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর হাজার হাজার গ্রামবাসী থানা ঘেরাও করে সেখানে থাকা সব পুলিশকে হত্যার হুমকি দেয়। দিনভর আলাপ আলোচনার পর গভীর রাতে পুলিশের সদস্যদের থানার ভেতর থেকে উদ্ধারের সময় উপপরিদর্শক (এসআই) সন্তোষ চৌধুরীকে বাছাই করে ছিনিয়ে নিয়ে থানা চত্বরেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন ৬ আগস্ট তাঁর মরদেহ থানার সামনে একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বানিয়াচংয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা শেষ পর্যন্ত সন্তোষ চৌধুরীকে জনতার হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে অনঢ় অবস্থানে ছিল বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মানুষেরা। সেনাবাহিনীর সঙ্গে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), জেলা প্রশাসক (ডিসি); এমনকি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা একযোগে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সন্তোষ চৌধুরীকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে তারা সব পুলিশকে চাইতেছিল মারার জন্য, কিন্তু সেনাবাহিনী দেয় নাই। একপর্যায়ে তারা বলছিল যে “সন্তোষকে না দিলে আমরা রাস্তা ছাড়ব না। আপনারা একজনকেও নিয়ে যেতে পারবেন না।”’ ওই দিন থানায় অবরুদ্ধ পুলিশের অর্ধশতাধিক সদস্যকে উদ্ধার করে নিরাপদে হবিগঞ্জে সরিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। বানিয়াচং থানা থেকে সেদিন সেনা সহায়তায় উদ্ধার হওয়া একজন পুলিশ কর্মকর্তা মো. আবু হানিফ বলেন, তাঁরা যে বেঁচে ফিরবেন, সেটা ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে আলোচনা করছে যে “একটা লোককে কেমনে আমরা দিই।” পরে আর উপায় না পাইয়া আটকাতে পারে নাই। আমরা ভাবছিলাম, তারে থানার ভেতরে রাইখা আমাদের উঠায়া তারপর সেনাবাহিনী একটা কিছু করবে। সেনাবাহিনী হয়তো তাকে এসকোর্ট করে নেবে, কিন্তু দেখা গেছে যে সে (সন্তোষ) যখন থানার ভেতর থেকে বের হয়ে লাইনে দাঁড়াইছে, তখনই পাবলিক তাকে থাবা মেরে নিয়ে গেছে।’ এ ঘটনার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এসআই সন্তোষকে কেন টার্গেট করা হলো, তার পেছনে দুটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, ৫ আগস্ট গুলি করা এবং এলাকায় পুলিশ হিসেবে তাঁর অতীত ভূমিকা। উদ্ধার হওয়া পুলিশ কর্মকতা জানান, ওই দিন গুলি চালিয়ে একাধিক মানুষ হত্যার দায়ে সন্তোষ চৌধুরীকে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া অতীতের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও একটি অংশ তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল বলে জানান এলাকার লোকজন। বানিয়াচংয়ের স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, তাঁর (এসআই সন্তোষ) ওপর কিছু মানুষের ক্ষোভ ছিল। ‘সে অনেক মানুষরে জ্বালাইছে। যারা আওয়ামী লীগ ভিন্ন আছিল, তাদের ধরছে, টেকা পয়সা আদায় করছে। তার প্রতি ক্ষোভ ছিল।’ থানার কাছে গ্রামের একজন বাসিন্দা অবশ্য ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তোষকে টার্গেট করার বিষয়টি সামনে আনেন। তাঁর ভাষায়, ‘থানা থেকে সে (এসআই সন্তোষ) মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাইত। মাদক ব্যবসায়ী যারা আছে, তাদের সে গ্রেপ্তার করত। আইনের আওতায় আনত। কোর্টে দিত। একজন যদি ব্যবসার মধ্যে ক্ষতি করে, তারে চাইব জড়ানোর লাগি। যারা মাদকের ব্যবসা করে, তারাই উঠাল “সন্তোষ চাই, সন্তোষ চাই।”’ সন্তোষ কেন গুলি করতে গেলেন, এ প্রশ্নের জবাবে থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হানিফ বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে সন্তোষ ভেবেছিল, গুলি করলে ওরা চলে যাবে। হাজার হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করে ইটপাটকেল মারতেছিল, থানা পোড়ায় দিছিল। যে দোতলা বিল্ডিং, তার প্রত্যেকটা রুম আগুন দিয়ে পোড়ায় দিছিল। নিচতলায় আগুন, ওপর তলায় একটা রুমে আমরা বন্দী ৬০/৬৫ জন। নিচে অস্ত্রাগার পুড়তেছিল আর ধোঁয়া আমাদের চোখে মুখে লাগতেছিল। হয়তো আর ১০/১৫ মিনিট থাকলে আমরা শ্বাসকষ্টে মারা যাইতাম। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের মতো ঘটনা ঘটত আরকি।’
৫ আগস্ট সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের উপস্থিতির পরও সন্তোষকে কেন রক্ষা করা গেল না, সে রকম জিজ্ঞাসা আছে তাঁর পরিবারের। তাঁর বাবা বলেন, ‘সেনাবাহিনী উদ্ধার করতে গেছে, আমরা শুনেছি; তো যাওয়ার পর অন্যরা সবাই আসছে, ও একাই রয়ে গেছিল। প্রশ্ন জাগে, কিন্তু সদুত্তর পাই না।’ সন্তোষ চৌধুরী পরিবারের একমাত্র ছেলে। মৃত্যুর ১০ মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁর একটি সন্তান হয়েছে। সন্তোষের মা বলেন, ‘আমার ছেলে তো চাকরিতে গেছিল। চাকরি করছিল। এটা তো আমার মা হইয়া অনবরত প্রশ্ন জাগে যে সব বাঁচল, আমার ছেলে কেনে বাঁচল না। কেনে আসল না?’ বানিয়াচং থানায় হামলা এবং পুলিশ হত্যায় গত বছরের ২২ আগস্ট পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। সে মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বানিয়াচং থানার পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, মামলা তদন্তের অগ্রগতি সামান্য, কোনো গ্রেপ্তারও নেই। এ রকম ঘটনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘ও মাই গড! এটা তো হতে পারে না। এটা হতে পারে না। হয়তোবা পুলিশটা দোষী। হয়তোবা ওই পুলিশ অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। বিচার করেন। বিচার করে তাকে শাস্তি দেন। দিয়ে জেলে রাখেন, এটাই তার শাস্তি। আপনি যদি তাকে মেরে ফেলেন, আপনি তো একটা এনার্কিকে উৎসাহিত করলেন।’ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশ পুলিশের কমপক্ষে ৪৪ জন সদস্য নিহত হন বলে সরকারি সূত্রে জানানো হয়। পুলিশের এই সদস্যদের অনেকেই সহিংস হত্যার শিকার হন। বিভিন্ন স্থানে, এমনকি থানার মধ্যে আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন পুলিশের সদস্যরা। জুলাই-আগস্টে পুলিশের বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পুলিশের ওপর মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ কাজ করেছিল। কিন্তু তার জন্য এভাবে হত্যা কাম্য নয় বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবীরা। মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘আমার মনে হয়, এই বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। যাঁরা সম্পৃক্ত, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। একটা হত্যা, যেটাই হোক না কেন, সবকিছুরই কিন্তু একটা ডায়েরি থাকা উচিত এবং সেটা লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। সেটা থেকে কী ঘটনা ঘটেছিল, তার তদন্ত হোক, চার্জশিট হোক অথবা ফাইনাল রিপোর্ট হোক; যেটাই হোক না কেন, সেটাও কিন্তু থাকা উচিত। কারণ, এটা তো ইতিহাস, এই ইতিহাস অনেক বছর যাবে।’ থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশের সদস্য মেরে ফেলার ঘটনায় মামলার অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া ২০২৪ সালের অক্টোবরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় এক প্রকার দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলেও সমালোচনা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান বিবৃতির খবর দেখিয়ে বলেন, ‘মামলা করতে পারবেন না, গ্রেপ্তার করা যাবে না, হয়রানি তো প্রশ্নই ওঠে না। এইটাই তো দায়মুক্তি। ১৫ জুলাই থেকে শুরু করে ৮ আগস্ট পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেটা কি আপনার আইনের লঙ্ঘন, সেটা কি আপনার এমন কোনো ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে যে আপনি সেটাকে দায়মুক্তি দিলেন? সুতরাং অনেকগুলো প্রশ্নের কিন্তু আমরা কোনো উত্তর পাই না।’ এ ধরনের দায়মুক্তি টিকবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধ করে থাকে, সে ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়া যায় না। এগুলো টিকবে না।’
Leave a Reply