মঙ্গলবার, ০১ Jul ২০২৫, ০৬:২৬ অপরাহ্ন

দখল-দূষণে হুমকির মুখে হবিগঞ্জ জেলার নদ-নদী

দখল-দূষণে হুমকির মুখে হবিগঞ্জ জেলার নদ-নদী

স্টাফ রিপোর্টার॥ জলে ভাসা পদ্মের মতোই সাগর মোহনায় অসংখ্য ছোট ছোট ভূখণ্ডের সমষ্টিই হচ্ছে বাংলাদেশ। পাখির দৃষ্টিতে দেখলে যত না ভূমি, তার চেয়ে বেশি জলাশয়। কিন্তু অতিদ্রুত বদলে যাচ্ছে এই দৃশ্যপট। দখল-দূষণ এবং কথিত উন্নয়নে মরে যাচ্ছে নদী। বিলীন হচ্ছে খাল-বিল-হাওর-পুকুর। দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে মাটির ওপরের ও নিচের জলভান্ডার। দখল-দূষণে কেবল নয়, নদী মরে যাচ্ছে উন্নয়নেও। এর বুকে এখন আর নৌকা চড়ে না, মাঝিও গান গায় না। মরে যাওয়া শুকনো নদীতে এখন মাঝে মধ্যেই রাখাল গরুর পাল নিয়ে ঘাস খাওয়াতে নামেন। খরস্রোতা হারিয়ে যৌবনহীনা এসব নদীর কান্নাই যেন এখন নিত্যসঙ্গী। তবুও এসব দেখার যেন কেউ নেই। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে নদ-নদীর সঠিক সংখ্যার তথ্য নেই। নদী নিয়ে গবেষণা করে এমন সংস্থার তথ্যমতে, এক সময় বাংলাদেশে নদ-নদীর (উপনদী-শাখা নদীসহ) সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানের ২৩০টির মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক নদী। এগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আদি যুগে সহজ যোগাযোগের কারণেই নদী তীরে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে সত্তরের দশকেও নদীপথে পণ্য পরিবহন হতো বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় এ চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে। দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ নদ-নদী। জেলার উল্লেখযোগ্য ৫০টির বেশি নদ-নদীর মধ্যে বর্তমানে কোনরকম ৩০টি নদীর অস্তিত্ব নির্ধারণ করা গেলেও অস্তিত্বহীন প্রায় ২০টি নদী। যেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ মৃতপ্রায়। অনেক নদীর দু’পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। দখল আর দূষণের কবলে পড়ে চরম নাব্য সংকটে সেগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। একদিকে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে নদী হারাচ্ছে তার নাব্যতা। সত্তরের দশকে হবিগঞ্জে ৫০টির বেশি নদী ছিল। তবে এখন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় আছে মাত্র ৩০টি নদীর নাম। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে হবিগঞ্জ থেকে প্রায় অর্ধেক নদীর নামই মুছে গেছে। অস্তিত্ব নেই বেশির ভাগ নদীর সঙ্গে জুড়ে থাকা শতাধিক খালের। এসব নদী ও খাল দখল করে গড়ে উঠেছে বসতি,ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনা। দীর্ঘ সময় ধরে খনন না করায় সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়া নদীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যে ৩০টি নদী এখনও টিকে আছে সেগুলোও পরিণত হয়েছে খাল বা নালায়। সেই সঙ্গে নদী শাসনে মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে কুশিয়ারা, কালনী, খোয়াই, সুতাং, রত্না এবং করাঙ্গীর মতো বড় নদীগুলোও। এগুলোর দু’পাশে গড়ে উঠেছে বড় বড় স্থাপনা। দূষণ কবলিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এসব নদী। এক সময়ের খরস্রোতা শাখা বরাক নদীর নাম অজানা নয় কারোরই। এই নদীতে এক সময় চলাচল করতো লঞ্চ ও ট্রলার। নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এই এলাকার বাসিন্দারা। যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ শহর। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই নদী পথ। কালের পরিক্রমায় গেল ৪ দশকে এই জেলার অধিকাংশ নদীর মতো শাখা বরাকও হারিয়েছে তার যৌবন। দখল-দূষণের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে নদীটি এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে।
সুতাং নদীর অবস্থা আরও ভয়াবহ। শিল্পবর্জ্যের দূষণে নদীটি এখন মৃতপ্রায়। দখলের কবলে বিলীনের পথে বাহুবলের করাঙ্গী ও মাধবপুরের সোনাই আর শুঁটকি নদী। চরম সংকটে রয়েছে রত্না এবং হবিগঞ্জ শহরকে ঘিরে থাকা খোয়াই নদীটিও। নদীমাতৃক জেলা হবিগঞ্জে বর্তমানে নদীর সঠিক তথ্য না থাকলেও ৫০ বছর আগে এই জেলায় ৫০টিরও অধিক নদীর অস্তিত্ব ছিল। এখন সব মিলিয়ে ১৫-২০টির মতো নদীর দেখা মিলে যার বেশিরভাগই রয়েছে দখলদারদের কবলে। দখল-দূষণসহ নানা কারণে হুমকির মুখে রয়েছে এখানকার নদ-নদীগুলো। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যে নদীগুলো হুমকির মুখে রয়েছে এর মধ্যে কালনী, কুশিয়ারা (ভেড়ামোহনা), মরা কুশিয়ারা, মরা বিবিয়ানা, হাওয়াই, শুটকী, ঝিংড়ী, ঘরদাইর, রত্না, শাখাবরাক, করাঙ্গী, বিজনা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, বছিরা, হাঙ্গরভাঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে নদীগুলোয় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সরু খালে পরিণত হয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নদ-নদীগুলো ড্রেজিং না করে নদীর দুইপাড় দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ, নদীগুলো থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করায় নদ-নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি হাওর অঞ্চল মরুভূমির রূপ ধারণ করতে চলেছে।
সরেজমিন ঘুরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলাসহ জেলার পার্শবর্তী উপজেলার নদীঘুলো ঘুরে দেখা যায়, একদিকে চলছে নদী দখল, অন্যদিকে শিল্পের নামে কলকারখানার বর্জ্য ফেলে দূষিত করা হচ্ছে নদীকে। সুতাং, খোয়াই ও পুরনো খোয়াই নদী বর্তমানে অত্যন্ত সঙ্কটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। খোয়াই নদী ভারত থেকে জলসীমিতকরণের আওতায় পড়ে ক্ষীণতোয়া হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে কিছু মানুষের অসৎ কর্মকাণ্ডের ফলে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সুতাং নদী। নদীর ভেতর অবকাঠামো নির্মাণ, অপরিকল্পিত এবং অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন, নদী দখল এবং দূষণের ফলে অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে আমাদের নদীগুলো।
শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার অলিপুরে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলার কারণে নদীটির পানি এখন কালো কুচকুচে। অথচ একসময় খরস্রোতা সুতাং নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা চলাচল করত। নদীর পানি দিয়ে আশপাশের লোকজন ফসল ফলাতেন। পাওয়া যেত দেশীয় প্রজাতির মাছ। এখন আর সেই চিত্র নেই। যৌবন হারিয়েছে নদীটি। সুতাং নদীর এই পরিণতির কারণ শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার অলিপুরে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য।
বিশিষ্ট পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘নদীর সংখ্যা নির্ধারণের আগে নদীর সংজ্ঞা আমাদের জানতে হবে। দখল-দূষণের বাইরেও নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করতে হবে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। এ জন্য দখল এবং দূষণই মূলত দায়ী। এ জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়। আসলে নদী না বাঁচলে পরিবেশ এবং প্রতিবেশ বাঁচবে না। আর এসব না বাঁচলে মানুষও বাঁচবে না। তাই নদী রক্ষার বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্ম থেকেই নখ-দন্তহীন জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন কাজের এখতিয়ার হচ্ছে, সমস্যা চিহ্নিত করণ এবং সুপারিশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যা অনেকটা হিংস্র হায়না ঠেকাতে পাটকাঠি নিয়ে অবস্থান নেয়া অথবা চোরকে ধর্মের কাহিনি শুনানোর মতো। কিন্তু প্রবচন আছে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি!’ অথচ বিশাল প্রত্যাশা ও কথা বলে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩। এ আইনের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক নদীদূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে এ কমিশন গঠন করা হলো।’ আইনে এত এখতিয়ারের কথা বলা হলেও ভেতরে বিশাল শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন দিয়ে এ পর্যন্ত প্রাপ্তি, ‘ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু’র চেয়ে বেশি কিছু নয়। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের উদ্দেশ্য এবং অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিক বাস্তবায়ন, আদৌ সম্ভব কিনা— সঙ্গত কারণেই জনমনে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, খোয়াই নদীর তলদেশ শহর থেকে অন্তত ১৫ ফুট উঁচুতে। এছাড়া ড্রেজিং না করায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে কমেছে পানির ধারণ ক্ষমতা। এ অবস্থায় অপরিকল্পিতভাবে মাটি-বালু উত্তোলনের ফলে পরিবর্তন হচ্ছে নদীর গতিপথ।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ‘যখন বাঁধের উপর রাস্তা করা প্রয়োজন হবে তখন বাঁধের ডিজাইন লেভেলটা জানতে হবে। পরবর্তীতে বাঁধটা যাতে উঁচু লেভেলে থাকে।’ খনন ও শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণসহ নদী রক্ষার দাবি দীর্ঘদিনের।
তবে, সম্প্রতি খোয়াই নদী পরিদর্শনে এসে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক) বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন স্থানীয় জনগণের সাথে আলোচনা করে স্থায়ীভাবে এই সমস্যার কীভাবে সমাধান দিতে পারে সেই অনুযায়ী আমাদের পরামর্শ দিবে। সে অনুসারে এইখানে কাজগুলো করা হবে।’
হবিগঞ্জের বাল্লা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভারতের আঠারমুড়া পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া খোয়াই নদী। জেলার ৫টি উপজেলার ওপর দিয়ে।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com