সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন

বেদখলে থাকা রেলের হাজার কোটি টাকার ভূমি ও সম্পদ উদ্ধারে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ

বেদখলে থাকা রেলের হাজার কোটি টাকার ভূমি ও সম্পদ উদ্ধারে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ

নুরুল আমিন, চুনারুঘাট থেকে ॥ ৩২ বছর ধরে বন্ধ হবিগঞ্জ-বাল্লা ট্রেন। এ কারনে নানা কৌশলে লুট করে নেয়া হয়েছে হাজার কোটি টাকার রেলের সম্পদ। দীর্ঘদিন চলে গেলেও পুনরায় চালু করা যায়নি হবিগঞ্জ-বাল্লা ট্রেন। পরিত্যক্ত থাকার কারণে লুট হয়ে গেছে রেলের শত শত কোটি টাকার সম্পদ। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে দখল করে নেয়া হয়েছে রেলের কোটি কোটি টাকার ভূমি। রেলের কর্মচারীরা যারা বিভিন্ন স্টেশনে অবস্থান করতেন তারাও রেলের জমি দখল করে ভবন নির্মাণ করে বসবাস করছেন। কোনো কোনো কর্মচারী রেলের ভূমিতে ভবন নির্মাণ করে ভাড়াটিয়া বসিয়ে টাকাকড়ি পকেটস্থ করছেন। হবিগঞ্জ-বাল্লা রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয় বৃটিশ আমলে। বৃটিশ সরকার ১৯২৮ সালে বাল্লা রেলপথ নির্মাণ করে গড়ে তুলে অবকাঠামো। ৩৬ কিলোমিটারের মধ্যে হবিগঞ্জ বাজার, হবিগঞ্জ কোর্ট, শায়েস্তাগঞ্জ জং, শাকির মোহাম্মদ, বড়কোটা, সতং বাজার, চুনারুঘাট, আমুরোড, আসামপাড়া এবং ত্রিপুরা সীমান্ত ঘেঁষা বাল্লা-এ ১০ টি স্টেশনের মধ্যে চলাচল করতো কয়লার ইঞ্জিন চালিত ট্রেন। এর মধ্যে চুনারুঘাট, আমুরোড এবং আসামপাড়া স্টেশন গুলোর গুরুত্ব ছিল বেশি। ওই ৩টি স্টেশন থেকে ২২টি চা বাগানে উৎপাদিত চা রেলপথেই চালান দেয়া হতো। কম খরচে চা বাগানের শ্রমিক রসদ, চা বাগানে ব্যবহৃত নানান সরঞ্জামাদি, সার-কীটনাশকসহ নানান পণ্যও আসতো বাল্লার ট্রেন দিয়েই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাল্লা ট্রেনের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এ কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে খ্যাত সুতাং ও বড়কুটা নামে আরো দুটি স্টেশন গড়ে তুলে রেল কর্তৃপক্ষ। সে সময় ভারত থেকে শরণার্থী ফিরিয়ে আনার কাজে ট্রেনটির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ সময় বাল্লার ট্রেনে যুক্ত হয় ডিজেল ইঞ্জিন। ট্রেনটি দিনে দু’বার করে যাতায়াত করতো হবিগঞ্জ থেকে সীমান্ত স্টেশন বাল্লার মধ্যে। শরণার্থী পরিবহন পর্ব শেষ হওয়ার পর বাল্লার ট্রেনটি দখলে নেয় চোরাকারবারিরা। পরবর্তীতে বাল্লার ট্রেনটি চোরাকারবারিদের ট্রেনে পরিণত হয়। প্রথম প্রথম এ নিয়ে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও পরবর্তীতে বিনা টিকিটে ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে চুপসে যান যাত্রীরা। এ অবস্থা চলতে থাকা ট্রেনটি লোকসানের মুখে পড়ে। রেল কর্তৃপক্ষ রেল লাইনের সংস্কার কাজ স্থগিত করে দেয়। ট্রেনটি চলতে থাকে চরম ঝুঁকি নিয়ে। গতিবেগ নেমে আসে ১৫ কিলোমিটারে। এ অজুহাতে এরশাদ সরকারের আমলে প্রথম এ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। যাত্রীদের আন্দোলনের মুখে ১ সপ্তাহের মধ্যেই পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয় এ পথে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর বাল্লার ট্রেনের চলাচল আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ট্রেন চলাচলের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। সেই কারণে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেনটি চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিছুদিন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলার পর আবার বন্ধ করে দেয়া হয় ট্রেনটি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলমন্ত্রী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে শায়েস্তাগঞ্জবাসী সংবর্ধনা প্রদান করে। এ সময় তিনি বাল্লা ট্রেনটি কিছুদিনের মধ্যে চালু করবেন বলে আশ্বাস দেন। সুরঞ্জিত সেন রাজনৈতিক শিকারে পরিণত হলে বাল্লার ট্রেন আর চালু করা যায়নি। এখনো বাল্লার ট্রেন বন্ধই আছে।
এলাকাবাসীরা জানান, বাল্লা রেল স্টেশনের ৭টির অবস্থান চুনারুঘাট উপজেলায়। সে কারণে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ট্রেনটি চালু, ট্রেনের ভূমি উদ্ধারসহ বিভিন্ন দাবি উঠে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে। নির্বাচনের প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগের নেতারা বাল্লার ট্রেন চালু করার আশ্বাসও দিয়েছেন কিন্তু ১৫ বছর চলে যাবার পরও ট্রেন চালু করার বিষয়ে জড়ালো কোন কথা নেতাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি। চুনারুঘাট-মাধবপুর উপজেলার (হবিগঞ্জ-৪) সংসদ সদস্য এডভোকেট মাহবুব আলী বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার পর এলাকার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ মনে করেছিলেন, মন্ত্রী মাহবুব আলীই পারেন এলাকার ঐতিহ্য বাল্লা ট্রেনকে পুনরায় চালু করতে। আর সে আশায় পথপানে চেয়ে ছিলেন সাধারণ মানুষ কিন্তু তিনিও রেল লাইন চালুর কোন ব্যবস্থা করতে পারেননি। পরবর্তীতে এলাকায় এমপি হন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক। তিনি নানা স্থানে বক্তৃতা করতে গিয়ে বাল্লা ট্রেন চালুর বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন কিন্তু সেটাও হয়ে উঠেনি। এরই মাঝে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের অঘোষিতভাবে বন্ধ হওয়ার পর থেকেই একটি প্রভাবশালী মহল রেলের বিশাল সম্পদের দিকে নজর দেয়। পরে আবার হবিগঞ্জ থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইনটি উঠিয়ে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়। তার সাথে শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেল লাইনের প্রায় ৩৬ কিলোমিটার সড়কের রেলের শিক, পাথর, সিগন্যাল, তার, নাটবল্টু ও ওজন মাপার যন্ত্রপাতি এবং ৭টি স্টেশনের অবকাঠামোসহ কোটি কোটি টাকার মালামাল লুটপাট শুরু হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৯৯ ভাগ লুটপাট হয়েছে। লুটপাটকারীরা অনেকেই এখন বিলাস বহুল বাড়ি ও গাড়ির মালিক। এছাড়া এ রেলপথের কোটি কোটি টাকার সরকারী জমিও দখল করে নিয়েছে একশ্রেণীর লোকজন। এসব জমিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি ও সবজি বাগান গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পরিত্যক্ত স্টেশন ঘরগুলো ভেঙে পড়ছে। এ পথ পুনরায় সংস্কার করে ট্রেন চালু হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন নির্দেশনা আসেনি। আর যদি ট্রেন চালু না হয় তবে শায়েস্তাগঞ্জ জংশন নাম পাল্টে স্টেশন হবে। কারণ জংশন থাকতে হলে ফাঁড়ি রেলপথ থাকতে হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ মানুষ মনে করেছিলেন, রেলের বেহাত হওয়া ভূমি উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে কিন্তু এখনও এর কোন ছিটেফোঁটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে মানুষ হতাশ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com