স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জে জামিনের ভুয়া নথি দেখিয়ে কারাগার থেকে মাদক মামলার চার আসামির ছাড়া পাওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. জাহাঙ্গীর আলম সম্প্রতি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গতকাল বুধবার হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন প্রধান অভিযুক্ত ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী হোসাইন মো. আরিফ।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়- এই মামলার প্রধান আসামী হবিগঞ্জ আদালতের বানিয়াচং ও বাহুবল জিআরও শাখার স্টেশনারি বিয়ারার হোসাইন মোহাম্মদ আরিফ, মাদক কারবারে অভিযুক্ত আব্দুর রউফ ও ভূয়া জামিননামায় কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া রুয়েল আহমদ, আলী হোসেন, আজাদ মিয়া এবং মো. সুয়েব মিয়াকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে হবিগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, জেলা কারাগার ও ডাচ-বাংলা ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখার সিসিটিভি ফুটেজ ছাড়াও ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার রশিদ, প্রধান আরিফের সাথে আরেক অভিযুক্ত আব্দুর রউফের সাথে মুঠোফোনে কথোপকথনের রেকর্ড সহ আরো কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করে দাখিল করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে পুলিশ জানায়- মামলার অভিযুক্ত হোসাইন মোহাম্মদ আরিফ ৭/৮ বছর ধরে হবিগঞ্জ সদর কোর্টে কাজ করার সুবাদে জিআর সেরেস্তা সহ আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে অবগত। অপরদিকে আব্দুর রউফ বিভিন্ন অভিযোগে ১৭টি মামলার আসামী। উভয়ের মধ্যে দীর্ঘদিন পরিচয় ও যোগসাজস রয়েছে। এরই ধারবাহিকতায় ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাদক মামলার ৪ আসামীর ভূয়া জামিননামা তৈরি করে তা হবিগঞ্জ কারাগারে দাখিল করেন আরিফ। এর মাধ্যমে ৪ আসামী কারগার থেকে ছাড়া পান। আসামী আরিফ বিভিন্নভাবে জড়িত করে এসআই সুকোমল, কোর্টের কর্মচারী পঙ্কজ ও ঘটনার উদঘাটনকারী আইনজীবী সহকারি অজিতকে জড়িয়ে আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেন। বাস্তবে ঘটনাকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করতে ও নিরপরাধ লোকজনকে ফাঁসাতে আরিফ মিথ্যা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যা তদন্তে বের হয়ে এসেছে।
এদিকে জামিনে থাকা প্রধান অভিযুক্ত হোসাইন আহমেদ আরিফ গতকাল বুধবার হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তিনি তার লিখিত বক্তব্যে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদানকালে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কথোপকথন উল্লেখ করেন। সেসময় ম্যাজিস্ট্রেট তাকে বলেন- যা বলতে চাও তা সত্য বল আর যদি মিথ্যা বল তাহলে তোমাকে রিমান্ডে পাঠানো হবে। পরবর্তীতে আমি রিমান্ডের ভয়ে সত্য বলতে রাজি হই। এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আরিফ জানান- তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। যে কারণে তিনি আইনী প্রক্রিয়ার উপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
ফৌজদারি মামলার এ পর্যায়ে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক আইনগত প্রক্রিয়ার বিষয়ে মন্তব্য করা নিয়ে কথা হয় হবিগঞ্জ আদালতের আইনজীবী এডভোকেট সুমায়েল আহমেদের সাথে। তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রসঙ্গে বলেন- এটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত একটি জবানবন্দি। এতে কারো প্রভাব থাকে না। এটা নেয়ার পূর্বে ৩ ঘন্টা সময় প্রদান করা হয়। যাতে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রকৃত বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন। ইচ্ছা করলে একজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান না করার অধিকারও আছে। এরপর যদি কেউ এই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দেয়া নিজের স্বীকারোক্তি নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য বা তথ্য প্রকাশ করেন, তাহলে এটা বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হবে।
হোসাইন আহমেদ আরিফের তোলা অভিযোগ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ কোর্ট ইন্সপেক্টর শেখ নাজমুল হক বলেন- যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠতার সাথে মামলার ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করে বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। হোসাইন মোহাম্মদ আরিফ সহ মোট ছয় আসামীর বিরুদ্ধে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার ভিত্তিতেই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য- গত ৬ জানুয়ারি জেলার মাধবপুরে ৩৫ কেজি গাজাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়ে ৪ মাদক কারবারি। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মাদক কারবারিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফয়সল আদালতে বেশ কয়েকবার তাদের জামিন আবেদন প্রার্থনা করেন। কিন্তু আদালত তাদেরকে জামিন দেননি।
সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারিও তাদের জামিন আবেদন করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে বুধবার তারা জামিনে বের হয়ে যান। বিষয়টি জানতে পেরে (৩০ জানুয়ারি) বৃহস্পতিবার অ্যাডভোকেট ফয়সল আদালতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি নিশ্চিত হন তার আসামিরা ভুয়া জামিননামা তৈরি করে জিআরও অফিসের মাধ্যমে জেলা কারাগারে প্রেরণ করেছে। পরে সেখান থেকে তারা ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান।
পরে তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় হোসাইন মো. আরিফকে আটক করা হয়। তিনি আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি আমল আদালত-৬ এর জিআরও এএসআই মো. মীর কাশেম বাদী হয়ে আরিফকে প্রধান করে আরও ৬ জনের নাম উল্লেখ করে জালিয়াতির অভিযোগে সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
Leave a Reply