নিজস্ব প্রতিনিধি ॥ চুনারুঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি বরাদ্দের প্রতিটি খাতেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে কৃষি অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করছেন কর্মকর্তা মাহিদুল ইসলাম। কৃষকদের জন্য ধান কাটার মেশিন, সয়াবিন, ভুট্টা ও বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি চাষের যন্ত্রপাতি বরাদ্দ এনে তা প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে তার পছন্দের লোক দিয়ে অন্যদের নিকট বিক্রি করার অভিযোগ আছে। এছাড়া ট্রেনিং ও প্রদর্শনীর নামে কৃষকদের এনে নামমাত্র নাস্তা ও সামান্য নগদ টাকা ধরিয়ে দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর ও টিপসই নিয়ে বিদায় করা হয়। কৃষি অফিসটা তিনি দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করছেন এ কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে- কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, প্রদর্শনী, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বরাদ্দসহ বিভিন্ন খাতের বরাদ্দের সিংহভাগ লুটপাট হচ্ছে। তারা কৃষকদের নিয়ে একটি ফসলের মাঠ দিবসের অনুষ্ঠান করে ব্যানার টাঙিয়ে ছবি তুলে রেখেই বরাদ্দের টাকা আত্মসাত করে চলেছেন। এছাড়া প্রতিটি বরাদ্দের কলাম ফাঁকা রেখেই স্টক-রেজিস্টারে নেওয়া হয় কৃষকদের স্বাক্ষর ও টিপসই। এসব অভিযোগের সত্যতার খোঁজে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রদর্শনীতে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষকদের জন্য বরাদ্দের চার ভাগের তিন ভাগই চলে যাচ্ছে কৃষি কর্মকর্তা মাহিদুল ইসলামের পকেটে। সরকারি বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশও কৃষকরা পাচ্ছে না। অফিসের যন্ত্রপাতি (মেশিন) থেকে শুরু করে প্রতিটি খাত থেকে কৃষি কর্মকর্তার বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশ গ্রহণকারী কৃষকদের মানসম্মত নাস্তা ও খাবার দেওয়া হচ্ছে না বলেও জানান অন্তত ১৫ জন কৃষক। তার কাছে কৃষকরা ন্যায় সঙ্গত কোন দাবী উত্থাপন করলে তিনি বলেন, আমাকে আইন শেখাবেন না।
তিনি ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে দাপট দেখিয়ে ধরা কে সরাজ্ঞান করে চলেছেন। তার কাছে কোন সংবাদকর্মী তথ্য চাইলে তিনি কোন পাত্তাই দেননি। বিগত সরকারের পতনের পর ও ছাত্রলীগ নেতা দাবীদার এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এখনো দাপটের সাথে চুনারুঘাট উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে বহাল তবিয়তে থেকে অনিয়ম দুর্নীতি করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত রয়েছেন। ভুক্তভোগীরা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আশুদৃষ্টি কামনা করছেন।
বেশির ভাগ কৃষকই জানেন না, তাদের জন্য সরকার কি পরিমাণ বরাদ্দ দিচ্ছে এবং কৃষকরা পাচ্ছেন কতটুকু। তারা বলছেন, আমরা তো এত কিছু জানিও না, আর বুঝিও না। কৃষি অফিসে বরাদ্দের পরিমাণ জানতে চাইলে পরে আর কিছুই দেয় না। উল্টো তার নাম কেটে দেওয়ার হুমকি ধমকিও দেন এ কর্মকর্তা। এতে কৃষকরা মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি সূত্র বলছে, উন্নত মানের ধান, গম, পাট ও ভুট্টার বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণের নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫ জন কৃষককে ৫ একরের একটি করে প্রদর্শনী প্লট দেওয়ার কথা। কোন গ্রুপে ১৫ হাজার আবার কোন গ্রুপে ১০ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। হেক্টর প্রতি কৃষকের জন্য যে পরিমাণ বীজ, সার, কীটনাশক, নগদ টাকাসহ যেসব উপকরণ দেওয়ার কথা তাও দেওয়া হয়েছে নামেমাত্র। এএসসিপি প্রকল্পের মাধ্যমে রয়েছে কৃষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতিটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন ৩০ জন কৃষক। ওই প্রশিক্ষণে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী কৃষকের জন্য খাবার বাবদ বরাদ্দ ৪০০ টাকা এবং ব্যাগ বাবদ ৬৫০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও কৃষকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ১০০ টাকা দামের ১ প্যাকেট বিরিয়ানি আর ১০০ থেকে ১৫০ টাকার একটি ব্যাগ। তাদের অভিযোগ বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের মানসম্মত নাস্তা ও খাবার দেওয়া হচ্ছে না। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার নিকট কৃষক ও যন্ত্রপাতি বরাদ্দের তালিকা চাইলে তিনি আজ নয় কাল, এমন টালবাহানা করে তালিকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ প্রতিবেদক কাগজপত্রের জন্য কৃষি অফিসে অন্তত কয়েকবার গিয়ে তার কাছ থেকে এসব তথ্য নিতে পারেননি। একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, চলতি বছরে চুনারুঘাট উপজেলায় ধান এবং ভুট্টা কাটার মেশিন ৮টি, কম্বাইন হারভেস্টার ২টি, রিপার ৪টি, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ওয়াকিং টাইপ ২টি ও পাওয়ার স্প্রেয়ার ১টি বরাদ্দ দেওয়া হয়। চুনারুঘাট উপজেলায় ভুট্টা চাষ না হলেও এ কর্মকর্তা লুটপাটের উদ্দেশ্যে ধান কাটার মেশিন বাদ দিয়ে ভুট্টা কাটার মেশিনের চাহিদা প্রেরণ করেন। আর সেই বরাদ্দকৃত মেশিনগুলো প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে তার অনুগত লোকজনের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে ফটোসেশান করে ওই মেশিন অন্যদের নিকট নামেমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেন। ৪টি রিপার পেলেও ওইগুলো তার পছন্দের এক দালালের মাধ্যমে অন্য জেলায় নিয়ে বিক্রি করার অভিযোগ উঠে। চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কৃষকদের নামে কৃষি যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ জিনিসপত্র, মেইজ শেলার মেশিন বরাদ্দ দেখানো হলেও কৃষকরা এর কিছুই পান না। পুষ্টি বাগানের জন্য বিভিন্ন গ্রুপে ১৪৫ জন কৃষককে ৩ হাজার ৭০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতি কৃষককে ৫টি গাছের চারা, ১০০ টাকার বীজ ও ২০০ টাকার সার দিয়ে বাকি টাকা সম্পূর্ণ তার পকেটে রেখে দেন বলে অভিযোগ করেন অনেক কৃষক। এসএসিপি প্রকল্পের আওতায় বাগান পরিচর্যার জন্য শতাধিক কৃষককে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এতে প্রত্যেক কৃষকের জন্য ১০ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়ার কথা থাকলেও কৃষি কর্মকর্তা সাদা-কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ১ হাজার টাকা করে ধরিয়ে দেন। এ নিয়ে কৃষকদের সাথে কর্মকর্তার বাকবিতণ্ডাও হয়েছে বলে একাধিক কৃষক এ প্রতিবেদকে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও এসএসিপি প্রকল্পের আওতায় কৃষক ট্রেনিংয়ের নামে ২০ টাকার নাস্তা, ১০০ টাকার দুপুরের খাবার ও নগদ ১০০ টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই চলছে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরটি। বরাদ্দের বিষয়ে অফিসের এক সহকারী বলেন, কৃষক ও কৃষি যন্ত্রপাতি বরাদ্দের কোনো কপি আমাদের দেওয়া হয় না। অফিস থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়, আমরা ডায়েরিতে নোট করে নেই। এ বিষয়ে জানতে চুনারুঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
Leave a Reply