সংবাদদাতা ॥ বাংলাদেশে চা কতটা জনপ্রিয় তা চায়ের দোকান গুলোর দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। দিন-রাত চায়ের দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। শুধু তাই নয়, অনেক বাঙালি পরিবারে সকালে আর বিকালে চা নিশ্চিত থাকবেই। এই চা নিয়ে অনেক গল্পই প্রচলিত আছে। এসব গল্পের মধ্যে একটি গল্প এরকম যে একবার এক বৌদ্ধ তপস্বী ধ্যানে থাকাকালীন সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এজন্য তিনি তার চোখের পাতা কেটে ফেলেছিলেন। বলা হয় সেই চোখের পাতা থেকে দশটি চা গাছ জন্ম নিয়েছিল। তবে চা পাতা নিয়ে চীন দেশের সম্রাটকে নিয়ে গল্পটি বেশ জনপ্রিয়। একবার চীন দেশের সম্রাট শেন নুং জল ফোটাচ্ছিলেন। সেই সময় একটি গাছের কিছু পাতা উড়ে জলের উপর পড়ে। এই জলের স্বাদ দেখে মুগ্ধ হন সম্রাট। এই সম্রাটের আরেকটি গুণ ছিল যে উনি ঔষধি গুণ পরীক্ষা করতেন। তিনি চা পাতার ঔষধি গুণ দেখে মুগ্ধ হন। ধীরে ধীরে এই চা এখন সমস্ত বিশ্ব দখল করেছে। বলা হয়ে থাকে জলের পরেই দ্বিতীয় পানীয় এখন চা।
বাংলাদেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ লাখ কেজি। ফলে চা রপ্তানির দিকে নজর দিতে পারে। বাংলাদেশে চা উৎপাদনকারী জেলাগুলো হলো মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাঙ্গামাটি। এসব জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার। মৌলভীবাজারে চা বাগানের সংখ্যা ৯২টি। এছাড়া হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে ৩৭টি, রাঙ্গাসাটিতে ২টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১০টি। ১৯৪৭ সালে চা চাষে ব্যবহৃত ভূমির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৭৩৪ হেক্টর। ২০২২ সালে চা বাগানে মোট ভূমির পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৮৭ হেক্টর। বাংলাদেশে চা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান হলো- বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এটি ১৯৫৭ সালে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ চা বোর্ড রয়েছে। এটিও চা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড-এর উদ্যোগে ২০২৫ সালের ২১ মে চা দিবসের প্রতিশ্রুতি, চা শিল্পের অগ্রগতি প্রতিপাদ্য নিয়ে জাতীয় চা দিবস ২০২৫ উদযাপন করে। প্রতিষ্ঠানটি নানাভাবে চায়ের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গলে দ্বিতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালু করে। বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় গ্রিন টি কারখানা স্থাপন করে। ২০২১ সালে চট্টগ্রামে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করে। ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো টি টেস্টিং অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল কোর্স চালু করে। এই বছরই উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে অর্থাৎ পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারিতে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র চা বাগানে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন করে। ২০২৩ সালে জাতীয় চা পুরস্কার নীতিমালা ২০২২ প্রকাশ, টি সফ্ট অ্যাপ, ও পঞ্চগড়ে তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র উদ্বোধন করে। এই চা এখন বাংলাদেশিদেরও প্রিয়। ১৮৪০ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক চা চাষ করা হয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটে মালনিছাড়ায় বাংলাদেশে প্রথম চায়ের বাগান করা হয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে এই চা বাগানের সংখ্যা এখন প্রায় ১৭০টি। ২০২৩ সালে ১৬৮টি চা বাগানে মোট উৎপাদিত চা ছিল ১০ কোটি ২৯ রাখ কেজি। এটি ১৮৪ বছরের ইতিহাসে প্রথম যার উৎপাদন ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ চা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম। এটি বিশ্বের ৩% চা উৎপাদন করে। এর মাধ্যমে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চা রপ্তানি করে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে চা রপ্তানির পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় লাখ কেজি। ২০২০ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি। ২০২৩ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৪০ হাজার কেজি। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে চা রপ্তানি করে। আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে এর উৎপাদন কমে যায় বিধায় জলবায়ুসহিষ্ণু চায়ের জাত উদ্ভাবন প্রয়োজন মনে করেন চা বিজ্ঞানীরা। কেননা, সাধারণ ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা চা চাষের জন্য ভালো হলেও নানা কারণে এর থেকে বেশি তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া কৃত্রিম সেচ, নতুন জাত ও প্রশিক্ষিত চা শ্রমিকদের কথাও বলা হচ্ছে। তবে চা শিল্পের আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমন- রাসায়নিক সারের অপ্রাচুর্য্যতা, গুদামের সমস্যা, উৎপাদনের উচ্চব্যয়, চায়ের বস্তা, মোড়ক বা বাক্সের সমস্যা, যন্ত্রপাতির ঘাটতি, জমি ইজারা নিয়ে বিরোধ, শ্রমিক অসন্তুষ্টি ইত্যাদি। চায়ের উৎপাদন বাড়াতে হলে, সম্ভাবনাময় চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে এইসব বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের পর থেকে বাংলাদেশে চা চাষের উপযোগী বৃষ্টি হয়নি বলে এর উৎপাদন কমেছে। চা চাষের জন্য নিয়মিত ও মাঝারি বৃষ্টি প্রয়োজন। তবে এখানে আরও কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে চা বাগানে গাছের তিন-চতুর্থাংশ কয়েক দশক এমনকি শত বছরের পুরোনো। ফলে এসব গাছ থেকে গুণগত মানের চা পাতা যেমন পাওয়া যাবে না, তেমনি উৎপাদনও কম হবে। এছাড়া পোকামাকড় প্রভৃতির প্রভাবেও চায়ের পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালের রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের পরের বছরই অর্থাৎ ২০২৪ সালে এর উৎপাদন কমে গেছে অনেক। ২০২৩ সালে যেখানে চায়ের উৎপাদন ছিল ১০ কোটি ২ লাখ কেজি সেখানে ২০২৪ সালে এসে এর উৎপাদন নেমে এসেছে ৯ কোটি ৩০ লাখ। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন প্রতিকূল আবহাওয়ার কথা। তাই এই সকল বিষায়াবলীর দিকে নজর দেওয়ার এখন সময় এসেছে। চায়ের উৎপাদন যেন আরও বাড়ে, সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি।
Leave a Reply