২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। পরীবাগের বাসায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। জানান, তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যেতে হবে।
তবে আবদুল মান্নান একাই নন। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও। এরপর তাঁদের জোরপূ্র্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়, আর ব্যাংকটি দখল করে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেন গোয়েন্দা সংস্থাটির তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। ক্ষমতায় তখন শেখ হাসিনার সরকার। ওপর মহলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি।
১০ বছর আগেও আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দেশে আনার সেবা দিয়ে গ্রাহক আস্থার শীর্ষে ছিল ইসলামী ব্যাংক। আমানত আর ঋণ বিতরণে ব্যাংকটি এখনো সবার চেয়ে এগিয়ে। ২০১৭ সালে ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ গ্রাহক ছিল এস আলম গ্রুপ, ঋণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, এমডিসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্রুপটির ভালো যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এই বছরের জানুয়ারিতে তাঁদের সবাইকে সরিয়ে এস আলম গ্রুপই যখন ব্যাংকটি দখল করে নেয়, তখন সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
নিজেদেরই এক গ্রাহককে একেবারে ভিন্ন রূপে দেখতে পান ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চেয়ারম্যান ও এমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর নতুন কর্মকর্তা নিয়োগে চাপ দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর সব পর্যায়ে ডিজিএফআইয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের যুক্ত থাকতে দেখা যায়। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে জামায়াত–সমর্থিত হওয়ায় অভিযোগ থাকায় ওই সময়ে কেউ এর প্রতিবাদও করেননি।
নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এস আলম গ্রুপ ধীরে ধীরে ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করে ও তাদের নিজস্ব লোক হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকার বাসিন্দাদের ব্যাপক সংখ্যায় ব্যাংকে নিয়োগ করতে শুরু করে। এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম পটিয়া অঞ্চলের হওয়ার কারণে ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ওই এলাকার মানুষ বিশেষ সুবিধা পান।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা যখন পরিবর্তন হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। তাঁর মেয়াদ শেষে ২০২২ সালের জুলাইয়ে গভর্নর হিসেবে যোগ দেন আব্দুর রউফ তালুকদার, যাঁকে আর জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। এই দুই গভর্নরের মেয়াদেই ব্যাংক লুটে এস আলমকে সহায়তা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাঁদের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কার্যালয় ও গুলশানে গভর্নরের বাসভবন ‘গভর্নর হাউস’ হয়ে উঠেছিল এস আলম গ্রুপের মালিক ও কর্মকর্তাদের বিচরণক্ষেত্র। নিজের মেয়াদে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকটি থেকে আরও অর্থ পাচারে সহায়তা করেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
ব্যাংকটিতে যা ঘটেছে, সে ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে চান না ফজলে কবির। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সময়ে মালিকানা পরিবর্তন হয়েছিল, এটা মনে আছে। তবে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, সেটা ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও এমডি বলতে পারবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির বিষয় নিয়ে আমি এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য প্রসঙ্গে ফজলে কবির বলেন, ‘এস আলম সাহেব সিঙ্গাপুরে থাকায় অনেক সময় তাঁর কর্মকর্তারা আসতেন। আমি কখনো কাউকে অতিরিক্ত সুবিধা দিইনি। দেশে ৬১টি ব্যাংক, সে কারণে হয়তো ইসলামী ব্যাংকের দিকে বাড়তি নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। ব্যাংক ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হলেই কেবল বাড়তি নজর দেওয়া হয়। এখন নিশ্চয়ই
তদারকি হবে।’
Leave a Reply