সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ০১:১৫ অপরাহ্ন

সৃষ্টি নাকি ধ্বংস : শিক্ষাঙ্গন যাচ্ছে কোন পথে

সৃষ্টি নাকি ধ্বংস : শিক্ষাঙ্গন যাচ্ছে কোন পথে

৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের হোলিখেলা শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে চারটি অনাকাঙ্কিত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। কোন পরিবর্তনেই এমন হোলিখেলা জাতি প্রত্যক্ষ করেনি। ছাত্রদের হাতে চরমভাবে নিগৃহীত, লাঞ্চিত হয়ে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়নি। অনেকে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে, এসব অনাকাঙ্কিত উল্লাসকে সমর্থন করেছেন। যুক্তি দিয়েছেন, এঁরা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়েছে, পতিত সরকারের সহযোগী ছিল। সরকারের সহযোগী হওয়ার বিষয়টি অমূলক নয়। একবারও কি ভেবে দেখেছেন, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারের সহযোগী না হয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন কি সম্ভব ছিল? বিপরীতে হামলা মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে এ গরীব শিক্ষকরা কি আয় রোজগারের একমাত্র পেশাটি হারিয়ে, পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসতে হতো না? তাহলে তাঁদের অপরাধটি কোথায়? অপরাধ তো করেছে সমাজ, রাষ্ট্র ও শাসকরা! রাষ্ট্রতো শিক্ষককে, শিক্ষক হয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি! রাষ্ট্র এদেরকে লেজুরবৃত্তি ও তোষণকারী হতে বাধ্য করেছে। এ রাষ্ট্রীয় অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই তো, আপামর জনতা সংস্কারকে স্বাগত জানিয়েছে। জনতার হৃদয়ে লালিত সেই সংস্কার কি তার প্রত্যাশিত পথে এগিয়ে যাচ্ছে?
প্রিয় পাঠক, ঢাকা এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো সংবাদ নিশ্চয়ই আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন,সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পলাশ বখতিয়ার। এ দুটো সংবাদ কিসের ইঙ্গিত বহন করে? অতীতে আমরা দেখেছি ছাত্র রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

পদ-পদবীর নেশায় মোহগ্রস্ত শিক্ষকরা, গবেষণা আর শিক্ষকতার পরিবর্তে ছাত্র নেতাদের তোষণে ব্যস্ত থাকে। ছাত্রনেতারা খুশি না থাকলে ভিসি, প্রো ভিসি হওয়া যেমন সম্ভব হয়ে উঠে না, আবার সেসব নেতাদের অবাধ্য হলে পদ-পদবীতে ঠিকে থাকাও সম্ভব হয় না। এই দেয়া নেয়ার নীতিতে দূর্নীতি গ্রস্ত হয়ে উঠে শিক্ষাঙ্গন। মানুষ হওয়ার পরিবর্তে নৈতিকতা বিবর্জিত এক শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠে, কলুষিত হয় সমাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট যদি অনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষাঙ্গন গড়ার প্রত্যয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে সাধুবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? এক সমন্বয়কের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে কি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে? উত্তরে বলেছেন, ‘ না’! এর অর্থ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়া কোন ছাত্র সংগঠন তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠা কি অবান্তর হবে যে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্র সমাজের মাঝে একটি চরম বৈষম্য সৃষ্টির পথকেই উম্মুক্ত করছে? সকল ছাত্র সংগঠনকে অবাঞ্চিত করে, বৈষম্য বিরোধীরা কি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দায়িত্ব পালনে ব্রতী হবেন? অদ্যাবধি অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে কোথাও বিপ্লবী সরকার বলা হয়নি। অথচ শাহজালালে ছাত্ররা বিপ্লবী সরকারের পক্ষে শপথ বাক্য পাঠ করান। কোন আইনে ছাত্র তাঁর শিক্ষককে শপথ বাক্য পাঠ করতে বাধ্য করেন? তাহলে সমন্বয়ক পলাশ আর তাঁর সহযোগীরা কি প্রো ভিসি, কোষাধ্যক্ষ আর রেজিস্ট্রার মহোদয়ের নিয়োগদাতা? নাকি নির্বাহী আদেশে রাষ্ট্র সেই সমন্বয়কদের শপথ পাঠ করানোর কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন? প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘ছাত্ররা আমাদের নিয়োগদাতা’! তাঁর এই বক্তব্যটি আবেগ মিশ্রিত অনুভূতির বহিপ্রকাশ হলেও, রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি-বিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংবিধান অনুযায়ী তিনি রাগ-বিরাগের উর্ধে উঠে দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছেন। সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকা উনার সাংবিধানিক দায়িত্ব। বিশ্ববরেণ্য মানুষ হিসেবে অতীতের শাসকদের চেয়ে তিনি ও তাঁর সরকার দায়িত্ব পালনে ব্যতিক্রমী হবেন, সেটিই প্রত্যাশিত। তাহলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালযে শপথের যে মহড়াটি অনুষ্ঠিত হলো, কোন বিধি-বিধানে তিনি সেটিকে সমর্থন করবেন। আর যদি সমর্থন না করেন সংশ্লিষ্ট ছাত্র ও শপথ গ্রহণকারী প্রশাসকদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? যদি কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা না হয়, তাহলে কি জাতি ধরে নেবে ছাত্রলীগের মতো বৈষম্য  বিরোধীদের কুর্নিশ করেই বিশ্ববিদ্যালয়েরর ভিসি, প্রো ভিসিদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষক নয়, ছাত্ররা শিক্ষকদের নীতি আদর্শের শিক্ষাগুরু হবে। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের ধারাবাহিকতার বাহিরে গিয়ে উচ্চগুণগত মান

সম্পন্ন একজন একাডেমিশিয়ান কে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে। এই সতীর্থকে জানি দীর্ঘদিন থেকে। তাছাড়া, আমার দু’বন্ধু দুুটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পেয়েছেন। মানে দু’জন দু’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মনোনীত হয়েছেন। সংবাদগুলো আমাকে উৎফুল্ল করেছিলো। এই উচ্ছ্বাসের পেছনে বন্ধুত্ব আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়; দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা আর মেধার সম্মিলিত প্রয়াসে গুণী শিক্ষাবিদদের দায?িত্ব প্রদানের দৃষ্টিভঙ্গিটি কাজ করেছিল। তাই সরকারের  প্রজ্ঞাপন প্রকাশের পর তাঁদের সাফল্য কামনা করে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। বন্ধুরাও প্রাণভরে দোয়া চেয়েছিলেন। একই সংগে একই বিভাগে লেখাপড়া করেছি। তাই দীর্ঘ কয়েক দশক যাবত তাঁদেরকে আলোর দিশারি হিসেবে জানি। পাণ্ডিত্য আর নৈতিকতা যাঁদের সৌন্দর্য, জ্ঞান দেয়া নেয়া যাঁদের ব্রত, সে মানুষগুলোর জন্য শুভকামনা ছাড়া বিকল্প কি হতে পারে। গতকালের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি দেখে, আমি সেই বন্ধুদের জন্য আতঙ্কিত। আমার গুণীজন বন্ধুরা কি সারা জীবনে অর্জিত ব্যক্তিত্ব আর নৈতিক মূল্যবোধকে অক্ষুন্ন রেখে দায?িত্ব পালনে সক্ষম হবেন? নাকি অর্জিত মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিবেন! তাঁদের যে বৈশিষ্ট্য আমার মতো অগণিত মানুষকে মোহাবিষ্ট করে, সে বৈশিষ্ট্যগুলো ছড়িয়ে দিতে পারলে, আলোকিত হবে সমাজ, কলঙ্কমুক্ত হবে শিক্ষাঙ্গন। গতকাল সিলেটে আমার রেজিস্ট্রার বন্ধুকে কায়মনোবাক্যে যেভাবে তাঁর ছাত্রদের পরিচালিত শপথ বাক্য পাঠ করতে দেখেছি, আমার ভিসি বন্ধুদের এমন দৃশ্য কোনদিনই জাতির প্রত্যাশিত নয়। আর যদি তাই হয়, খাদের কূলে হাবুডুবু খাওয়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সৃষ্টি নয় ধ্বংসকে-ই নিশ্চিত করবে। তাই গুণে মানে সমৃদ্ধ ভিসি মহোদয়দের বলতে চাই, পদ-পদবীর সম্মান ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী ঐশ্বর্যকে বিসর্জন দিয়ে, আপনাদের প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, আইন আর নৈতিক মূল্যবোধকে ছড়িয়ে দিন, দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে। ছাত্রদেরকে নিয়োগ কর্তা নয়, ছাত্র হিসেবে বিবেচনা করুন। সর্বোচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করুন।

মো: মাহমুদ হাসান
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com