মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ০৬:২৪ অপরাহ্ন

দেড়’শ বছরেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি ॥ ক্ষয়িষ্ণু সম্প্রদায়ের দিকে এখন ধাবিত

দেড়’শ বছরেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি ॥ ক্ষয়িষ্ণু সম্প্রদায়ের দিকে এখন ধাবিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাগানে কাজ নেই, ৮ জনের পরিবারে কাজ আছে মাত্র একজনের, মজুরি মাত্র ১৭৮ টাকা। এ টাকা দিয়ে কিভাবে সংসার চলবে? তাই বাধ্য হয়ে বাগানের বাইরে এসে এখানে সকালবেলা কাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ কাজে নিলে যাই, না হলে আবার বাসায় ফিরে যাই। কাজ না পেলে আসা-যাওয়া ৪০ টাকা গাড়ি ভাড়া চলে যায়, আর কাজ পেলেও তাই যায়। চুনারুঘাট শহরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন উপজেলার চন্ডিছড়া চা বাগানের শ্রমিক কুসুম মৃধা।
রোজ সকালে চুনারুঘাট বাজারের সতং রোড ও মাদ্রাসা মার্কেটের সামনে উপজেলার চন্ডিছড়া চা বাগানের কুসুম মৃধার মতো শত শত চা শ্রমিক এভাবেই কাজের জন্য শহরে এসে ভিড় করেন। অঞ্জলী তন্তবায় বলেন, বাগানে কাজ নেই, ছেলেমেয়ে নিয়ে ৭ জনের সংসার। তাই বৃদ্ধ বয়সেও এখানে (মাদ্রাসা মার্কেটের সামনে) এসে কাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। কুসুম আর অঞ্জলীর মতো উপজেলার কয়েক হাজার শ্রমিক বাগানের বাইরে মাটিকাটা, ধানকাটা, ধান রোপণসহ নানা ধরণের কাজ করেন। মজুরি পান ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে চুনারুঘাট বাজারের মাদ্রাসা মার্কেটের সামনে শ্রমিকদের হাট বসে। এখান থেকে শহর ও গ্রামের লোকজন এসে তাদের প্রয়োজনীয় শ্রমিক নিয়ে যান। সকাল ১০টার মধ্যে শেষ হয় এ শ্রমিক হাট। যারা কাজ পান তারা কাজে যান, আর যারা কাজ পান না তারা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফিরে যান নিজ বাসায়। তবে কাজ না পেলেও তাদের গুনতে হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকা ভাড়া। এছাড়া ওই দিন কাজ না পেলে তাদের অনেকের কষ্টে দিন কাটে। একাধিক সদস্যের সংসার নিয়ে কারো কারো একবেলা খেয়েও দিন কাটে। চা শ্রমিকদের দিনকাল ঃ চুনারুঘাট উপজেলার ২৩টি চা বাগানে চা শ্রমিক রয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার। অথচ নারী-পুরুষ মিলে কাজের উপযোগী শ্রমিক রয়েছেন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার। বাকিরা সবাই বাগানের বাইরে মাটিকাটাসহ নানা ধরণের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। চা বাগানের ১৭৮ টাকা মজুরিতে দিন চলে না। তাই অনেকেই বাগানের ছুটির দিনে বাগানের বাইরে কাজ করেন। বাগানের বাইরে শ্রমিকের কাজ করে মজুরি বেশি পাওয়া যায়। চা বাগানের শ্রমিকরা দিন আনে দিন খান, তাদের কোনো সঞ্চয় নেই, প্রত্যেক পরিবারেই ৪ থেকে ৮ জনের সদস্য রয়েছেন। অথচ কাজ আছে মাত্র ১ জন কিংবা দু’জনের। বাকিরা বাগানের বাইরে দিনমজুরি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। বাগানে কাজ করে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না। তাই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও কিছুটা ভালো থাকার জন্য তারা মাটি কাটাসহ নানা কঠিন কাজ করেন। চা গাছ যেমন ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না, তেমনি চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেওয়া ওই চা গাছের মতোই! লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুড়ে ঘরেবন্দি জীবন তাদের। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাঁধা তাদের নিয়তি। দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় চা শ্রমিকেরা সব দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিরক্ষরতা। দেশে বাজেটের একটা বিরাট অংশ যেখানে ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা খাতে, সেখানে চা বাগানের শিক্ষার হার অতি নগণ্য। দেশের চা শ্রমিকরা বহুকাল ধরে নিরক্ষরতা, নিপীড়ন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার মধ্যদিয়ে জীবনযাপন করে আসছেন। দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে।
দেশের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি রচনার সাক্ষী সেই চা বাগানের শ্রমিকরা আজও মানবেতন জীবন যাপন করছেন। দেশে বর্তমানে চা জনগোষ্ঠী ৭ লক্ষাধিক। তার মধ্যে দেশের নিবন্ধিত ১৬৭টি চা বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছেন প্রায় ৯৪ হাজার। আর অনিয়মিত শ্রমিক রয়েছেন ৪০ হাজার। ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণির বাগানগুলোতে নিবন্ধিত শ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক ৩২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৬৯ টাকা, ২০১৫ সালে ৮৫ টাকা, ২০১৬ সালে ১০২ টাকা, ২০১৮ সালে ১২০ টাকা এবং বর্তমানে ১৭৮ টাকা। বেতন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে চা শ্রমিক নেতা কাঞ্চন পাত্র বলেন, চা শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১৭৮ টাকা। তা দিয়ে একটা সংসার চলে না। তাই শ্রমিকরা বাগানের বাইরে নানা ধরণের কাজ করেন। চা শ্রমিক নেতা স্বপন সাঁওতাল বলেন, চুনারুঘাট উপজেলার ২৩টি চা বাগানে ১৮ হাজার শ্রমিকের বাগানে কাজ আছে। বাকি ৩০ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক বেকার। তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য গ্রামাঞ্চলে কাজ করছেন। বাগানের একটি ঘরে ৬ জন থাকলে ৫ জনেরই কাজ নেই। অথচ সংসারে ৫ থেকে ৮ জন খানেওয়ালা। তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা বাগানের বাইরে কাজ করে কোনোরকম দিনাতিপাত করছেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com