স্টাফ রিপোর্টার ॥ চুনারুঘাটের নয়ানী গ্রাম থেকে ৩০ কেজি গাঁজাসহ শরীফুল ইসলাম (৩০) নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করার পর রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দেয়নি পুলিশ।
গত ২৮ নভেম্বর রাতে গাঁজাসহ শরীফুলকে গ্রেফতার করা হয়। নানা কারসাজির পর উপজেলা ছাত্রদলের জনৈক নেতার তদবিরে ওসি নজরুল ইসলামের নির্দেশে ২৯ নভেম্বর দুপুরে সন্দেহভাজন দেখিয়ে ৫৪ ধারায় আদালতে চালান দেয়া হয়। ফলে আদালত শরীফুলকে ওইদিনই জামিন দেন। শরীফুল উপজেলার আমকান্দি এলাকার আব্দুল হাইয়ের পুত্র।
জানা গছে চুনারুঘাট থানার ওসি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে ২৮ নভেম্বর রাতে নয়ানী গ্রাম থেকে ৩০ কেজি গাঁজাসহ বশির ও শরীফুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু উপজেলা ছাত্রদলের জনৈক নেতার ঘনিষ্ঠভাজন হওয়ায় রাতেই ছুটে আসেন ওই নেতা। এরপর ওসিকে ম্যানেজ করে পরদিন দুপুরে তাকে নোহা গাড়ি দিয়ে হবিগঞ্জ আদালতে পৌঁছানো হয়। যা থানার সিসি ফুটেজ তল্লাশি করলে পাওয়া যাবে। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রদলসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকেই বলছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে একজন মাদক কারবারিকে রক্ষা করতে কেন ওই নেতা এমনটা করলেন। এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী জানান, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চোরাই কারবারিসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িত ওই নেতা। তিনি থানার ওসির সঙ্গে আতাঁত করে সীমান্তসহ উপজেলার চোরাই সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। বিষয়টি দলের ঊর্ধ্বতনদের অবগত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতাকর্মী।
তবে এ বিষয়ে ওসি’র সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে দারোগার সাথে কথা বলুন। পরে এসআই দেলোয়ারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, শরীফুলের কাছে গাঁজা পাওয়া যায়নি। তিনি ওসির নির্দেশে শরীফুলকে ৫৪ ধারায় চালান দিয়েছেন বলে জানান। অপর একটি সূত্র জানায়, ছাত্রদল নেতার মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শরীফুলকে ৫৪ ধারায় আদালতে চালান দেয়া হয়। অপরদিকে তাদের গ্রেপ্তার সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, ওসি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে শরীফুলের শশুর বাড়িতে অভিযান পরিচালনাকালে ইন্সপেক্টর তদন্ত সহ একদল পুলিশ শরীফুলকে সামনে রেখে কথা বলছেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মামলায় শরীফুলের নামও বাদ দেয়া হয়। এছাড়া ওসি নজরুল ইসলাম থানায় যোগদানের পর তিনি বিএনপি’র নাম ভাঙ্গিয়ে চলছেন। করছেন বিএনপিসহ সাধারণ মানুষের সাথে অশুভ আচরণ। ওসির অসাদাচরণে ক্ষুব্ধ খোদ বিএনপি নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। অভিযোগ উঠেছে কতিপয় উপজেলা ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বালু মহালে চাঁদাবাজি, চিনি পাচার ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন ঘটনায় তিনি মামলা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
ওসি নজরুল ইসলাম চুনারুঘাট থানায় যোগদানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শায়েস্তাগঞ্জ নতুনব্রীজ এলাকায় আন্দোলনকারীদের উপর হামলার মামলায় ৯৭ জনের নাম উল্লেখসহ প্রায় ২শ’ জনকে অজ্ঞাত আসামী দেখানো হয়। অজ্ঞাতনামাদের অনেকেই মামলায় গ্রেফতার বা জড়িয়ে দেয়ার হুমকী দিয়ে স্থানীয় একটি চক্রের সহযোতিায় বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। আসামীদের ঘরবাড়ী তল্লাশীর নামেও অনেকের নানা রকমের হুমকী প্রদর্শন করে হাতিয়ে নিয়েছেন অর্থ এমন অভিযোগও রয়েছে।
ইতিপূর্বে ওসি নজরুল ইসলাম মৌলভীবাজারে জেলার রাজনগর থানায় কর্মরত থাকাকালীন নানা রকম অপরাধ কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামাই করেছেন। যা ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি দৈনিক দেশরূপান্তর পত্রিকায় ‘ঘুষ তালিকায় গরু ছাগল মুরগি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সম্মানিত পাঠকদের জন্য দেশরূপান্তরের সেই রিপোর্টটি হুবুহু প্রকাশ করা হলো ঃ মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার ওসি নজরুল ইসলাম। গত বছর ১০ জুন এ থানায় তার যোগদানের পরেই বদলে যায় পুরো রাজনগর উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) থেকে শুরু করে দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক সালিশ বা জমির বিরোধ সবকিছুতেই এখন ওসি নজরুলের উপস্থিতি। রাজনগরের মানুষের মুখে মুখে এখন ঘুরছে ওসির ‘ঘুষের কারবারের’ অভিযোগসংক্রান্ত নানা মুখরোচক কাহিনী।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, কখনো পুলিশ সদস্যদের খাবার, আবার কখনোবা থানার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজসহ বিভিন্ন অজুহাতে টাকা আদায় করেন ওসি নজরুল। ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য’র পাশাপাশি পান থেকে চুন খসলেই তার ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি এখন সবারই জানা। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও ওসির ‘ঘুষ বাণিজ্য’র শিকার হওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। তবে নতুন করে বিপদে পড়ার ভয়ে তাদের অধিকাংশই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এদিকে ওসির ‘ঘুষ বাণিজ্য’র শিকার হওয়ার ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ এখন বড় বিপদে পড়লেও আর থানামুখী হতে চাইছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে একের পর এক অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না এলাকাবাসী। ওসি নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ গিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর আগে জেলার এসপি ও রেঞ্জ ডিআইজিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ গেলেও তার কর্মকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে তার ‘ঘুষের বাজার’ আরও জমজমাট হয়ে উঠে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক জনপ্রতিনিধি।
রাজনগর উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাকা ছাড়া রাজনগর থানায় বর্তমানে কিছুই হয় না। এমনকি ঘুষ হিসেবে ওসি নজরুল গরু, ছাগল এমনকি মুরগিও চান বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। এমনই একজন ভুক্তভোগী রাজনগর উপজেলা ছাত্রলীগের এক সাবেক সভাপতি, যিনি বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলা শ্রমিক লীগের নেতা। হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাজার ইজারা নেওয়ার পর আমাদের কাছে একটা গরু দাবি করেন ওসি নজরুল। পরে গরু দেওয়ার জন্য বিভিন্ন অফিসারদের (পুলিশ কর্মকর্তা) পাঠিয়ে বারবার চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ওসি বলেন, “৬০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে ফেলছি, আপনাদের আর গরু দিতে হবে না। নগদ টাকা দিয়ে দেন।” বিপদে পড়ার ভয়ে পরে আমরা ওই টাকা দিয়ে দিই। এভাবে ওসি অনেকের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন।’
কখনো থানার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের কথা বলে, আবার কখনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপনের কথা বলে ওসি নজরুল টাকা আদায় করেন অভিযোগ করে এই শ্রমিক লীগ নেতা আরও বলেন, ‘সুযোগ পেলে ওসি চান নিজের হাতে পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিতে। মানুষ এতটা ভয়ে যে বিপদে পড়লেও থানায় যেতে চায় না। পুলিশ বিভাগে এমন অফিসার দেশের কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই।’
একটি ঘটনায় ওসির রোষানলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে এলাকা ছেড়েছেন বলে দেশ রূপান্তরের কাছে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা। যদিও ওই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে জানিয়েছেন তিনি।
ওসির ‘ঘুষ বাণিজ্য’ থেকে রেহাই পাচ্ছে না হতদরিদ্র দিনমজুররাও। রাজনগরের পাচগাঁও ইউনিয়নের একটি ইটভাটার শ্রমিক বকুল মিয়া অভিযোগ করে জানান, কিছুদিন আগে প্রতিবেশীর সঙ্গে রাস্তা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তার প্রতিকার চেয়ে থানায় যান। ওসি প্রথমে তাকে মামলা করতে বলেন। কিন্তু তাতে রাজি না হলে ওসি ধমক দিয়ে তাকেসহ তার সঙ্গে থানায় যাওয়া সবার সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। দুদিন পর বাড়িতে একদল পুলিশ হাজির হয়ে তার ভাইকে আটক করে। তারা ১ লাখ টাকা দাবি করে এবং তিনি জানতে পারেন পুলিশ তাদের একটি মামলার আসামি করেছে। আর তিনি মামলা দিয়েছেন প্রতিবেশী মা ও ছেলের বিরুদ্ধে। এরপর বুঝতে পারেন যে, তার স্বাক্ষর রেখে ওসি মামলা সাজিয়েছেন। যদিও পরে বাধ্য হয়ে ঋণ করে একবার ৫ হাজার এবং আরেকবার সাড়ে ৪ হাজার টাকা দিয়েছেন পুলিশকে। এখন মামলার কারণে নিয়মিত আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে তাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খান বংশের এক প্রবাসী তরুণ টেলিফোনে দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদেশে যেতে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন পড়ে তার। এজন্য তিনি ১০ হাজার টাকা পুলিশকে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই তরুণ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি বাধ্য হয়ে দিয়েছি কারণ পুলিশ ক্লিয়ারেন্সটা আমার খুব প্রয়োজন ছিল। সাধারণ মানুষ ভয়ে এখন থানায় যায় না। থানায় গেলেই টাকা দিতে হয়ে। বাদী-বিবাদী সবাইকেই টাকা দিতে হয়।’
আরেক ভুক্তভোগী মনসুরনগর ইউনিয়নের আশ্রাকাপন গ্রামের ফয়েজ চৌধুরী বাচ্চু। তার অভিযোগ, কিছুদিন আগে বাড়ির রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেখা দিলে থানায় যান। ওসি তখন সালিশের নামে ৩২ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে বিরোধ মিটিয়ে দেন।
ওসি নজরুলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। গত ৩১ আগস্ট জেলার পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে লিখিত অভিযোগ দেন কামারচাক ইউনিয়নের হরিপাশা গ্রামের প্রবাসী শায়েস্তা মিয়া। অভিযোগে তিনি বলেছেন, বাড়িতে গাড়ির গ্যারেজ বানাতে গেলে প্রতিবেশীর সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে সালিশে বসার নামে প্রতিবেশীর পক্ষ নেন ওসি নজরুল। প্রতিবেশীকে ওই জায়গা ছেড়ে দিতে আমাকে চাপ দিতে থাকেন ওসি।
সর্বশেষ কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচন ঘিরে ওসি নজরুলের ‘ঘুষের বাজার’ আরও জমজমাট হয়ে উঠে বলে স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রাজনগরের একটি ইউপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান নাম গোপন রাখার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে ওসিকে পক্ষে রাখতে সবাই চেষ্টা করবে। আমিও যতটুকু করার করেছি, তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সালিশযোগ্য ঘটনায় কেউ থানায় গেলে ওসি দুই পক্ষকে দিয়ে দুটি ডায়েরি করান। পরে উভয়পক্ষকে ডেকে মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা নেন। এই উপজেলার প্রতিটি এলাকার মানুষ, ইউপি চেয়ারম্যানরা ওসির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।’
সম্প্রতি হওয়া ইউপি নির্বাচনের সময় ওসি নজরুল অধিকাংশ প্রার্থীর কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন দাবি করে টেংরা ইউপি চেয়ারম্যান টিপু খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় তিনি (ওসি) এমন কোনো প্রার্থী নেই যে যার কাছ থেকে টাকা নেননি। সব চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীর কাছ থেকে চাপ দিয়ে টাকা নিয়েছেন। এই ওসি থাকলে রাজনগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাই আমরা জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওসির থেকে দূরত্ব বজায় রাখব।’
ওসির ‘ঘুষ বাণিজ্য’র প্রতিবাদ করায় মিথ্যা অভিযোগে করা বেশ কয়েকটি মামলার আসামি হয়েছেন দাবি করে এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, ‘আমার বাসায় হামলার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় আমি মামলা করি, কিন্তু মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার না করে ওসি ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার শুরু করেন। আটজন ব্যবসায়ীকে আটক করে গ্রেপ্তার বাণিজ্য করেন। পরে আমি এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানাই এবং উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসে ওসিকে এ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করি। তখন তিনি সব চেয়ারম্যান এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সামনে উল্টো আমাকে ১০টি মামলায় জড়ানোর হুমকি দেন। আমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। আমার অপরাধ ছিল গ্রেপ্তার বাণিজ্যের প্রতিবাদ করা।’
এলাকার সাধারণ মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ওসির দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য একের পর এক উপস্থাপন করছে এবং সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার পরিবর্তে হয়রানির শিকার হচ্ছে দাবি করে গত ১৩ জানুয়ারি রাজনগর উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় আলোচনা করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ আটটি ইউপির নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ওসির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সেদিন আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় ওসিকে।
এ প্রসঙ্গে রাজনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাজান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ওসির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে রটে আছে। ওসি বিজয় দিবসেও যথাযথ সম্মান জানাননি। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ইউনিফর্মধারী হিসেবে পতাকা উত্তোলনের সময় স্যালুটরত অবস্থায় থাকার বিধান থাকা সত্ত্বেও তিনি জাতীয় পতাকাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করে দাঁড়িয়ে থাকেন।’
সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন ফ্রান্স আওয়ামী লীগের পর্যটনবিষয়ক সম্পাদক বাদল মিয়া। তার অভিযোগ, জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ মেটাতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দেওয়ার পরও তাকে তিনটি মামলার আসামি করে হয়রানি করেন ওসি। তিনি বিষয়টি জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের নজরে আনেন। নেতারা ওসিকে ফোন করে বিষয়টি দেখার জন্য বলেন। ওসি তখন ইতিবাচক সুরেই কথা বলেন। কিন্তু সেদিন রাতেই বাদল মিয়াকে ফোন করে ওসি বলেন, ‘এগুলো করে লাভ নেই। সাইন তো আমি করব।’
এরপর বাদল মিয়া বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে পুরো ঘটনা অবগত করেন। তখন মন্ত্রী ওসিকে ফোন দিয়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য এবং প্রবাসী এই আওয়ামী লীগ নেতাকে হয়রানি না করার জন্য বলে দেন। এতে আরও ক্ষেপে যান ওসি নজরুল। সেদিনই গভীর রাতে বাদল মিয়ার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে ওসি নজরুল বলেন, ‘মামলার কাগজ আমার হাতে, মন্ত্রী আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।’ এমন পরিস্থিতিতে এই প্রবাসী হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে গোপনে ফ্রান্স চলে যান। সেখান থেকে ফেইসবুক লাইভে এসে ওসির হয়রানির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
ওসি নজরুলের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রায় সব নেতা। রাজনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিলন বখত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজনগরের ইতিহাসে এমন ওসি আগে আসেনি। ওসি যখন প্রথম এখানে আসেন, আমি নিজেও উনাকে বলেছিলাম যে নতুন ওসি হয়েছেন, সুযোগ আছে ভালো কিছু করার। কিন্তু সার্বিক দিক মিলিয়ে অবস্থা ভালো নয়।’
তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা এতসব অভিযোগ অস্বীকার করে ওসি নজরুল ইসলাম একে রটনা বলে দাবি করছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কারণে যাদের স্বার্থ হাসিল হয়নি তারা হয়তো অভিযোগ দিচ্ছে। প্রতিটি মামলাতে একপক্ষ খুশি হয়, অন্যপক্ষ মনঃক্ষুণ্ন হয়। তারাই এসব রটায়।’
অবশ্য ওসি নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে। যেসব অভিযোগ এসেছে তার তদন্ত করে আমরা ব্যবস্থা নেব। সব বিষয় আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখব।’
১০
মোস্তাক হত্যা মামলায় গ্রেফতার আসামি রাডার দুলাল শূন্য থেকে শত কোটি টাকার মালিক
স্টাফ রিপোর্টার ॥ জমি দখল, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, কমিশন বাণিজ্য, সুদের ব্যবসাসহ আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়া আ’লীগ নেতা বাহুবলের দুলাল ওরপে রাডার দুলাল (৫০) কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হবিগঞ্জ শহরের মোস্তাক হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। সম্প্রতি তাকে মিরপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সে পশ্চিম জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা। এদিকে তার গ্রেফতার এরপর থেকেই বেরিয়ে আসছে অজানা কাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, দুলাল ওরফে রাডার দুলাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ার পর থেকেই বিগত সরকারের আমলে জোর করে জমি দখল, সুদের ব্যবসা, বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণসহ নিজস্ব লোকজন নিয়ে এলাকায় শুরু করেন আধিপত্য বিস্তার। তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে দুর্ধর্ষ বাহিনী। এলাকাবাসীর কাছে যা রাডার দুলাল বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এই বাহিনীর মাধ্যমেই তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখেন পুরো উপজেলার অধিপত্য।
এলাকাবাসী জানান, এক সময় যার কিছুই ছিলো না, শুধুমাত্র সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে তিনি আজ মেসার্স তাসিন ব্রিকস, মেসার্স সামিন ব্রিকস সহ ৪টি ব্রিকস ফিল্ড রয়েছে। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৪০টি ভিটে বাড়ি মার্কেট রয়েছে তার। পাশাপাশি শহরের সিনেমা হল এলাকায় দুইটি বাড়ি, ঢাকায় ৩টি ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন স্থানে বাসা বাড়ি রয়েছে। এর সুবাদে দেশের বাহিরে রেখে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছেন।
আরও জানা যায়, তার পিতা এক সময় ভ্যান গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়কে মেঘনা পরিবহনের একটি বাস খাদে পড়ে। সে সময় রাডার দুলাল ফেরি করে পান সিগারেট বিক্রি করতেন। কিন্তু খাদে পড়ে যাওয়া বাসের মালামাল লুট করে বিক্রি করার পর অভাব অনটন ঘুচতে থাকে। বিগত সরকারের আমলে সরকারের প্রভাব খাটিয়ে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হন। গত ২১ নভেম্বর যুবদল নেতার হাত পা কেটে ফেলার হুমকি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরের অভিযোগে বাহুবল থানায় মামলা হয়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
Leave a Reply