সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ০৩:২৬ অপরাহ্ন

 চা বাগানগুলোতে মাদকের ছড়াছড়ি কার্যকর হচ্ছে না বিজিবির অভিযানও

 চা বাগানগুলোতে মাদকের ছড়াছড়ি কার্যকর হচ্ছে না বিজিবির অভিযানও

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুরাতন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে নেমে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের মেঠোপথ ধরে কয়েক মিনিটের রাস্তা। বাগানের নাচঘর ও বটতালা গেটের একটু আগে ছয় শিশু-কিশোর ফাঁড়িপথের দুইদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিকেল তখন সাড়ে ৪টা। মাথায় হেলমেট পড়া চার যুবক দুটি মোটরসাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকাদের মধ্যে দুইজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন এবং তাদের হাতে টাকা ধরিয়ে দেন। পরে দুই শিশু চা গাছের আড়াল থেকে চারটি ভারতীয় ফেনসিডিল সিরাপ বের করে আগুন্তুকদের হাতে দেয়। তারা ছিপি খুলে নিমিষেই ফেনসিডিল মুখে ঢেলে দেন ও খালি বোতল বাগানের ভেতর ছুড়ে ফেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। এই তেলিয়াপাড়া চা বাগান হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত। ছয় শিশু-কিশোরদের একজনের সঙ্গে কৌশলে সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, মোটরসাইকেল আরোহীরা প্রতি বোতল ফেনসিডিল ১ হাজার ২০০ টাকা দামে কিনে পান করেছেন। আর শিশু-কিশোররা প্রতি বোতলে কমিশন পেয়েছেন ১০০ টাকা। বাগানের ফাঁড়ির রাস্তাগুলো ঘুরে দেখা যায়, চা গাছের ঝোপে থোকায় থোকায় অসংখ্য ফেনসিডিলের খালি বোতল ফেলে রাখা। মাদক বিক্রেতারা প্রতিদিন ওইসব বোতল কুড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে।
পরে নাচঘর ও বটতালা গেটে থাকা কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, নাচঘর থেকে প্রায় ৫ মিনিট হাঁটা পথ দূরে কয়েকটি মাটির ঘর। এগুলোর একটি ঘর ‘ফেনসিডিলের ডিলার’ খ্যাত এক চা শ্রমিকের। ঘরের ভেতর ফার্নিচারে সুসজ্জিত।
এখানে প্রতি বোতল ফেনসিডিল ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রয় হয়। ক্রেতারা ঘরের ভেতরে ঢুকে মিনিটখানেকের মধ্যেই ফেনসিডিল পান করে বের হয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বটতলায় মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার রেখে যাত্রীরা এই ঘরে আসা-যাওয়া করছেন। এ সময়ের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দুটি গাড়িকেও মেঠোপথ ধরে আসা-যাওয়া করতে দেখা গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তেলিয়াপাড়া বাগানে আরও অন্তত ১৫ জন তালিকাভুক্ত চা শ্রমিক মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের কাছে ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা ও বিয়ারসহ নানা প্রকার মাদক পাওয়া যায়। তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বটতলা থেকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতাড়ের বেড়া। ভোর রাতে কৌশলে এই বেড়ার ওপর দিয়ে মাধবপুরে মাদক ঢুকানো হয় বলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন। গাঁজা জব্দ হলেও ফেনসিডিল ব্যবসায়ীরা অধরা ঃ হবিগঞ্জ জেলায় মাসে কোটি টাকার মাদক জব্দ এবং মাদক কারবারিদের আটক করে বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু ফেনসিডিল বিক্রেতাদের গ্রেপ্তারের খবর যৎ সামান্য। অভিযোগ রয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যকে ম্যানেজ করে ফেনসিডিল বিক্রয় হয় তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। এ ব্যাপারে কথা বলতে বিজিবির তেলিয়াপাড়া সীমান্ত ফাঁড়ির অফিসিয়াল মোবাইল নম্বরে কল দিলে এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করে বলেন, ‘মাদক বিক্রয়ের কোনো প্রমাণ থাকলে আমাদের দিন; বিজিবি মাদক প্রতিরোধে কাজ করছে। আমরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিব। ’ ‘বিজিবির গাড়ি আসা-যাওয়া করে তারপরও কি প্রকাশ্যে মাদক বিক্রয়ের দৃশ্য নজরে পড়ে না?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। একপর্যায়ে সরাসরি গিয়ে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে লাইন কেটে দেন। সুলভ মূল্যে ফেনসিডিল কিনতে চা বাগানে ভিড় ঃ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতীয় মাদক ফেনসিডিল কারবারিরা মজুদের তারতম্যের ওপর প্রতিদিন দাম নির্ধারণ করেন। চা বাগানে সবসময় ১১শ থেকে ১২শ টাকায় প্রতি বোতল ফেনসিডিল বিক্রয় হলেও গত ঈদ মৌসুমে দাম বেড়ে ২ হাজার/২২শ টাকায় বিক্রয় হয়েছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় ফেনসিডিল বিক্রয় করা হয় ১১শ থেকে ১২শ টাকায়। কিন্তু হবিগঞ্জ শহরে এর দাম দুই থেকে আড়াইগুণ। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় প্রতি বোতল ৫ হাজারেও বিক্রয় হয়। এজন্য মাদকসেবিরা সীমান্তের চা বাগানে ভিড় করেন। অন্যান্য ব্যবসার আড়ালে ফেনসিডিলের চালান ঃ হবিগঞ্জসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় ফেনসিডিলের মূল্য কম হওয়ায় অন্যান্য অঞ্চলের কিছু লোক এর সুযোগ নিতে যাচ্ছেন। তারা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে মাদক নিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। গত ১২ মার্চ পাথর বোঝাই ট্রাকে করে পাচার করার সময় ৪০০ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল আটক করে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
তাঁরা জানায়, তল্লাশি চৌকিতে হলুদ রঙের একটি পুরাতন ট্রাককে সিগন্যাল দিলে চালক গাড়িটি থামিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে ট্রাক তল্লাশি করে ৪০০ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, অন্যান্য পণ্য আনা নেওয়া করা গাড়িগুলোতে প্রায়ই ফেনসিডিলের চালান থাকে।
পুরাতন মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঃ গত পহেলা এপ্রিল ঈদের পরদিন সন্ধ্যায় তেলিয়াপাড়ার পার্শ্ববর্তী সুরমা চা বাগানের ভেতরে ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়কে তিন মোটরসাইকেল আরোহী যুবক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আহত হন। এর আগে ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় একই উপজেলার আমতলিতে এক মোটরসাইকেল আরোহী দুর্ঘটনায় মারা যান। কয়েক মাস আগে আরও দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছিল সড়কটিতে। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ফেনসিডিল সেবনের পর অনেকেই দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালানো উপভোগ করেন। পুরাতন মহাসড়কে এভাবে প্রায়ই উঠতি বয়সী যুবকরা দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছেন।
মাদক কেনাবেচার তথ্য জানে চা বাগান কর্তৃপক্ষ ঃ এ ব্যাপারে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের সাবেক ব্যবস্থাপক দীপুল কুমার সিংহ বলেন, ‘প্রশাসনকে মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করতে দেখি। তবে সীমান্ত এলাকা হওয়ার কারণে পুরোপুরিভাবে মাদক কারবারিদের তারা প্রতিরোধ করতে পারছে না। ফলে বাগানের কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটছে। কারণ অপরাধ প্রবণ এলাকায় সাধারণ শ্রমিকরা কাজ করতে চায় না। ’পুলিশের ভাষ্য ঃ এ ব্যাপারে কথা হলে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) এএনএম সাজেদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ মাদক প্রতিরোধে সর্বত্র কাজ করছে। তেলিয়াপাড়ায় অবাধে মাদক বিক্রয়ের ব্যাপারটি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেব। ’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved 2024 DailyBijoyerProtiddhoni
Design & Developed BY ThemesBazar.Com