বিজয় ডেস্ক ॥ দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক কক্ষের ভাড়া বাসায় থাকতেন সাংবাদিক মো. মেহেদী হাসান। প্রতিদিন রাতে তাঁর বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকতেন স্ত্রী ও দুই মেয়ে। গত বছরের ১৮ জুলাইও সন্ধ্যার পর থেকে মেহেদীর ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এর আগে বিকেলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর বুক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মেহেদী অনলাইন সংবাদমাধ্যম ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। সেদিন যাত্রবাড়ীতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন তিনি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন মেহেদীসহ পাঁচজন সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যে তিনজন শহীদ হয়েছেন রাজধানী ঢাকায়; একজন সিলেটে, আরেকজন হবিগঞ্জে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীতে শহীদ হন মেহেদী হাসান, উত্তরায় শাকিল হোসেন ও ধানমন্ডিতে তাহির জামান। এ ছাড়া সিলেট শহরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হন সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব আর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে শহীদ হন সোহেল আখঞ্জী। সরকারি গেজেট অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সারা দেশে শহীদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। এ তালিকায় শহীদ পাঁচ সাংবাদিকের নাম রয়েছে। স্বামীকে হারিয়ে বিপর্যস্ত এই নারী বললেন, ‘মাথার ওপরে যে বটগাছটা ছিল, সেটা এখন নেই।’ ১০ জুলাই কথা হয় ফারহানার সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সহায়তা পেয়েছেন। তবে হত্যাকাণ্ডের বিচারের অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত ও থানায় দুটি মামলা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচারের অগ্রগতি নেই। আমার স্বামী যেভাবে মারা গেছেন, খুব সহজেই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা যেত।’ শাকিলকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন বাবা ঃ মেহেদী যেদিন (১৮ জুলাই) যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহীদ হন, সেদিনই বিকেলে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর থানার সামনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক শাকিল হোসেন। পুলিশের ছোড়া গুলি তাঁর বুকে বিদ্ধ হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ২৩ বছর বয়সী শাকিল মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি দৈনিক ভোরের আওয়াজ এর গাজীপুর মহানগরের গাছা থানার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। পরিবারের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায়। শাকিলের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায়। তাঁর বাবা মো. বেলায়েত হোসেন ব্যবসা করেন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শাকিল ছিলেন সবার ছোট। ছেলে হত্যার ঘটনায় শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন। ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় থাকা এই বাবা বললেন, ‘সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করেছে, কিন্তু ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না!’ আক্ষেপ নিয়ে দিন কাটছে তাহিরের মায়ের ঃ ১৯ জুলাই বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির গ্রিন রোডে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন ২৭ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী তাহির জামান (প্রিয়)। হঠাৎ পুলিশের গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। সে সময় ওই এলাকার আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ অনবরত গুলি করছিল। ফলে আশপাশে থাকা ছাত্র-জনতা তাঁকে উদ্ধার করতে পারেননি। পরে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তাঁর মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়। তাহিরের গ্রামের বাড়ি রংপুরে। তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে সাবিরা জামান এখন দাদি ও মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আছে। তাহির হত্যার ঘটনায় ঢাকার নিউমার্কেট থানা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছে তাঁর পরিবার। মা সামসি আরা জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারপ্রক্রিয়া যেভাবে চলছে, তাতে আমরা শহীদ পরিবারগুলো সন্তুষ্ট নই। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর কোথাও হয়নি যে দেশের রক্ষক এত রক্ত নিয়েছে! এই বিচারটা হওয়া উচিত ছিল অনেক দ্রুত। এক বছরের মধ্যে একটা ভালো অগ্রগতি দেখব, সে আশাই আমরা করেছিলাম।’ সামসি আরা জামান বলেন, ‘সন্তানের শূন্যতা তো কেউ পূরণ করে দিতে পারবে না! আমার সন্তান যে সম্ভাবনা নিয়ে চলে গেল, সারা জীবন এই কষ্ট থেকে যাবে। যখনই মিডিয়া বা ক্যামেরা দেখি, কারও সফলতা দেখব, সব সময়ই আমার মনে হবে যে আমার প্রিয় থাকলে আজকে এই জায়গায় যেত। এ আক্ষেপ নিয়েই হয়তো আমার সারা জীবন কাটবে।’ বিয়ের দুই মাসের মাথায় মৃত্যু তুরাবের ঃ ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর সিলেট নগরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সেখানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর সিলেট ব্যুরোপ্রধান আবু তাহের মো. তুরাব। পুলিশ সেই মিছিলে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হন তুরাব। সেদিন সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর তুরাবের পরিবার মামলা করতে গেলে তখন সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিয়েছিল পুলিশ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৯ আগস্ট মামলা করে পরিবার। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তুরাব ছিলেন সবার ছোট। গত বছরের ১২ মে লন্ডনপ্রবাসী তানিয়া ইসলামের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন ৩৪ বছর বয়সী তুরাব। বিয়ের মাত্র দুই মাস ছয় দিনের মাথায় তিনি শহীদ হন। তুরাবের বড় ভাই জাবুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে তুরাবের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। ভাইয়ের এ রকম মৃত্যু আমাদের পুরো পরিবারকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। আমার মায়ের বয়স প্রায় ৭০ বছর। জীবদ্দশায় তুরাব হত্যার বিচার দেখে যেতে চান আমার মা।’
সোহেলের মৃত্যুতে বিপর্যস্ত পরিবার ঃ ৫ আগস্ট হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার এল আর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সমবেত হন কয়েক শ শিক্ষার্থী। এরপর বের করা হয় মিছিল। মিছিলটি বড়বাজার হয়ে থানার সামনে দিয়ে রওনা হয়। পথে ঈদগাঁ এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাতে বাধা দেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও গুলি চালানো হয়।
গুলিতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন শহীদ হন। তাঁদের একজন ৩৫ বছর বয়সী সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জী। তিনি স্থানীয় দৈনিক লোকালয় বার্তার নিজস্ব প্রতিবেদক। সংবাদ সংগ্রহের কাজে ঘটনাস্থলে ছিলেন সোহেল। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন সোহেল আখঞ্জী। তাঁর মা বাবা আগেই মারা গেছেন। সোহেলের কোনো ভাই-বোন নেই। তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা বানিয়াচংয়েই থাকেন। সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকার আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে তাঁর পরিবার। মূলত এই টাকা দিয়েই এখন পরিবারটি চলছে। সোহেলের স্ত্রী মৌসুমী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুতে আমরা অনেকটাই বিপর্যস্ত। টাকাপয়সার অভাব ও আইনি ঝামেলা মোকাবিলার সামর্থ্য না থাকায় আমরা কোনো মামলা করিনি। তবে অন্যদের করা কয়েকটি মামলায় আমার স্বামীর নিহত হওয়ার বিষয়টা উল্লেখ আছে। স্বামী হত্যার বিচার চাই আমি।’ সোহেলের মতো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে পাঁচজন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন, তাঁদের সবার পরিবার দ্রুত ন্যায়বিচায় চায়। তবে বিচারের অগ্রগতি নিয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে।
তাঁদের ‘স্যালুট’ ঃ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তি হিসেবে অনেক সাংবাদিকই জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিলেন এবং আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। প্রতিষ্ঠানগতভাবেও দু-একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান তখন ইতিবাচক ও সাহসী ভূমিকা রেখেছে। যাঁরা আত্মদান করেছেন, তাঁরা কাজ করতে গিয়েই আত্মদান করেছেন। ওই সময় অনেক সাংবাদিক ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের অবশ্যই স্যালুট জানাতে হবে। তবে অধিকাংশ গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীর একটা বিরাট অংশ গণতন্ত্র ও গণআন্দোলনের পরিবর্তে বিভিন্নভাবে তৎকালীন সরকারের পক্ষেই ছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে পেশাগত কাজ করতে গিয়ে যেসব সাংবাদিক হয়রানি, নির্যাতন-নিপীড়ন বা মামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের মামলা প্রত্যাহার এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে সংস্কার কমিশনের করা সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন কামাল আহমেদ।
Leave a Reply